গ্রীক পুরাণের পক্ষীরাজ পেগাসাস এখন মানুষের মোবাইল ফোনে!





প্রেয়সীর মন জয় করতে পেগাসাসকে বশে এনেছিলেন গ্রীক পুরাণের রাজা বেলেরেফোন। আর এইসময়ে বিরোধীপক্ষগুলোর মুখে লাগাম দিতে পেগাসাসকে "বশে" আনছে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো। ভিন্নমতকে দমিয়ে রাখতে কতৃত্ত্ববাদী সরকারগুলো পুরাণের পাতা থেকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলছে বেলেরেফোনের পেগাসাসকে। যার শিকার হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক থেকে শুরু করে বিরোধী নেতা, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গও।  হুমকির মুখে পড়েছে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা, অভ্যন্তরীণ ও সাইবার নিরাপত্তার মতো জরুরী বিষয়গুলো।

পুরাণের পক্ষীরাজ "পেগাসাস" আকাশে রাজ করলেও এইসময়ের পেগাসাস রাজ করে বেড়াচ্ছে মানুষের মোবাইল-আইফোনে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের ফোন বা আইফোনেও তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নির্বিঘ্নে। এমনকি সাইবার নিরাপত্তার জন্য বিখ্যাত অ্যাপলের আইফোনগুলোতেও অবলীলায় সেঁধিয়ে যাচ্ছে পেগাসাস। হাতিয়ে নিচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সব ডেটা, রেকর্ড করছে কল, ফোন ক্যামেরা চালু করে ব্যবহারকারীর অগোচরেই তুলে নিচ্ছে ছবি, বন্ধ থাকা ফোনের মাইক্রোফোন সজাগ করে রেকর্ড করে ফেলছে ব্যক্তিগত আলাপও। লোকেশন ট্র্যাক থেকে শুরু করে ব্যক্তির অর্থনৈতিক লেনদেনসহ সারাদিনের ব্যস্ততার সঙ্গী হয়ে যাচ্ছে পেগাসাস। মালিকের অজান্তেই কষ্টের টাকায় কেনা মুঠোফোন পরিণত হচ্ছে শত্রুর নজরদারির যন্ত্রে। 

এভাবে শত্রুর হাতে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। বিশ্বের প্রায় ৪৫ টি দেশের ৫০ হাজার মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়েছে বা ফাঁস হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানাচ্ছে  বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। যাদের মধ্যে রয়েছেন তিনজন প্রেসিডেন্ট, তিনজন প্রধানমন্ত্রী, সাতজন সাবেক রাষ্ট্রনায়ক এবং একজন রাজা। এছাড়াও পেগাসাসের শিকারের তালিকায় রয়েছেন বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী, বিচারপতি, সরকারি কর্মকর্তা, বিরোধী দলীয় নেতা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও এনজিও কর্মীরাও। পেগাসাসের শিকারের এই তালিকা, পেগাসাস তৈরি করার ক্ষেত্রে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের ওই বক্তব্য সমর্থন করছে না, যাতে তারা বলেছেন এই স্পাইওয়্যারটি তারা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবিলা, শিশু পাচার এবং মাদকের বিস্তার রোধে তৈরি করেছেন। 

এনএসও গ্রুপ তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো অস্বীকার করলেও পেগাসাস-ঝড় কিন্তু এরফলে বিন্দুমাত্র দূর্বল হচ্ছে না। বরং দিন-বদিন এই পেগাসাস ইস্যুকে ঘিরে নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠছে রাজনীতিকদের টেবিল। পেগাসাসের শিকারে পরিণত হওয়ার আশংকায় ইতিমধ্যেই নিজের মুঠোফোন পাল্টে নিয়েছেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। অধিকতর টেকসই সাইবার নিরাপত্তাবলয় তৈরি করতে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকও ডেকেছেন তিনি।

এদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির বাগডোরও এবার করোনার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে ক্ষুদ্র এই স্পাইওয়্যারটি। পেগাসাস ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাহুল গান্ধীরা উত্তপ্ত করে তুলছেন দিল্লি-দরবার। পেগাসাস-কেলেংকারীর প্রতিক্রিয়ায় শাসকদল বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন বিরোধী নেতারা। যদিও ভারত সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে এতে রাষ্ট্রদ্রোহীতার রঙ লাগাতে চাইছে। 

 
অব্যাহত কূটনৈতিক চাপের মুখে হাত গুটিয়ে বসে নেই পেগাসাসের আঁতুড়ঘর ইসরায়েলও। ইতিমধ্যেই সেখানকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বিচার মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সামরিক নিরাপত্তা পরিষদ ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। যেটি পেগাসাস, ইমসি ক্যাচার ও এধরনের নজরদারিমূলক স্পাইওয়্যার সরঞ্জাম রপ্তানির ক্ষেত্রে কোন নীতিগত পরিবর্তন আনা উচিত কিনা তা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছে। যদিও এনএসওর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আদালতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আনা আবেদন খারিজ হয়ে গেছে এরইমধ্যে। 

এমনিভাবে নজরদারীর দায়ে অভিযুক্ত মরক্কোও পেগাসাস ইস্যুকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসা সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের হুমকি দিয়েছে। দেশটি ইতিমধ্যেই বলেছে, তারা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা এবং আইনের শাসন নিশ্চিতে দায়বদ্ধ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ফরবিডেন স্টোরিজ এবং শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর পেগাসাস বিষয়ক অনুসন্ধানকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়েছে দেশটি। একই কাজ করেছে নজরদারির দায়ে অভিযুক্ত আরো দুই রাষ্ট্র রুয়ান্ডা ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এই দেশদুটিও পেগাসাস ব্যবহারের অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে। 

 নজরদারির দায়ে অভিযুক্ত রাষ্ট্রগুলোর এরকম সাফাই অস্বাভাবিক নয়। অভিযোগগুলো কতটা গুরুতর তা সম্পর্কে সম্যক অবগত দেশগুলোর নীতিনির্ধারকেরা। আড়িপাতা সংষ্কৃতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে কতটা সাংঘর্ষিক তা তাদের অজানা নয়। এর বাস্তবিক দিকটাও দৃশ্যমান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেটিকে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির সাথে তুলনা করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেও পেগাসাস ক্রয়ের কথা স্বীকার করাটা ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর তাই সংকটময় এই পরিস্থিতিতে কোন দেশই মুখ খুলে বিপদ আরো বিস্তৃত করতে চাচ্ছে না। 

পেগাসাস ইস্যুটা এমন একসময়ে আলোয় এলো যখন পুরো বিশ্বই করোনায় জবুথবু হয়ে ঘরে সেঁধে গেছে। এমন এক অবস্থা পরিস্থিতির সুবিধা নেয়ার জন্য আদর্শ নয় বিরোধী দলগুলোর। আর তাই পেগাসাস ইস্যুটি হয়তো ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির মতো দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে যাচ্ছে না। তবে এর প্রভাব যে দীর্ঘমেয়াদে থেকেই যাবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। বিশেষত নজরদারির দায়ে অভিযুক্ত রাষ্ট্রগুলোতে সরকার বিরোধী পক্ষগুলো একে যে শক্ত হাতিয়ার হিসেবে হাতে নিয়েই মাঠে নামবে, এর পক্ষে চোখ বুজে বাজি ধরা যায়। 

পেগাসাস কেলেঙ্কারির প্রতিক্রিয়া যে কেবল ক্ষমতার ভরকেন্দ্রেই প্রভাব ফেলবে তেমনটা ভাবা খুব একটা যৌক্তিক নয়। ক্ষমতার মসনদে বদল হলেও পরিবর্তিত অধিকারীকেরাও যে এই "দৈবিক" ক্ষমতায় ক্ষমতাবান হতে চাইবেন না এমনটা ধারণা করা সহজ নয়। ক্ষমতার নিরংকুশ প্রবাহ নিশ্চিতে আজকের বিরোধীদের কাছেও ভবিষ্যতে পেগাসাস

ক্ষমতার মসনদে বদল হলেও পরিবর্তিত অধিকারীকেরাও যে এই "দৈবিক" ক্ষমতায় ক্ষমতাবান হতে চাইবেন না এমনটা ধারণা করা সহজ নয়। ক্ষমতার নিরংকুশ প্রবাহ নিশ্চিতে আজকের বিরোধীদের কাছেও ভবিষ্যতে পেগাসাসের আবেদন বাড়বে বৈ কমবে না। আর এর মেয়াদ অন্তত ততদিন হতে যাচ্ছে যতদিন একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে। তবে এই প্রযুক্তির আসল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে সাধারণ মানুষজনকেই। এনএসও গ্রুপ দাবি করেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ কোন গ্রাহকের বিরুদ্ধে পাওয়া গেলে তারা এই সুবিধা বাতিল করে দেয়। বিশ্লেষকদের ধারণা, রপ্তানির পড়েও যেহেতু এতে ইসরায়েলের কোম্পানিটির সক্ষনতা এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাহলে "ব্যাকডোর" দিয়ে গ্রাহকের তথ্য তাদের নিজেদের কাছে পৌঁছে যাওয়াটাও বিচিত্র নয়। এর আগে খাসোগী হত্যাকান্ডের সময়েও এনএসও গ্রুপ পেগাসাসের মাধ্যমে সৌদি আরবকে দেয়া নজরদারি সুবিধা বাতিল করে বলে জানা গেছে। 

এভাবে পেগাসাসের মাধ্যমে যে "ডাবল এজেন্টে"র ভূমিকা নিয়ে আশংকা করা হচ্ছিল তা ধীরে ধীরে বাস্তবে রুপ নিতে শুরু করেছে। নজরদারীর দায়ে অভিযুক্ত মরক্কোর অভ্যন্তর থেকে যেমন ফরাসী প্রেসিডেন্টকে টার্গেট করা হয়েছিলো, ঠিক তেমনি খোদ মরক্কোর ভেতর থেকেই টার্গেট করা হয় মরক্কোরই রাজাকে! যেটি " ডাবল এজেন্ট" নিয়ে বিশ্লেষকদের ধারণাকে আরো জোড়ালো করে তুলছে। 

যদি এরকমই বাস্তবতা হয়ে থাকে, তাহলে এরজন্য চিন্তায় কেবল নজরদারির শিকার হওয়া লোকেরই মাথা চুলকাতে হবেনা। বরং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে গর্বিত, শংকিত সকল মানুষকেই চিন্তিত হতে হবে। ভয়ংকর এক ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনার দোলনায় দোলা দিতে হবে মানুষকে, যেখানে শত্রুর সামনে মানুষের গোপনীয়তা বলে কিছুই থাকবেনা। শত্রু আপনাকে যেই ভবিষ্যতে চিনবে নিজের থেকেও বেশি।

হাসিবুর রহমান 
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক  






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ