ন্যাটো জোটসেনা প্রত্যাহার-পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তান আবারো সহিংস হয়ে ওঠেছে। কাবুল প্রশাসন ও তালিবানের মধ্যকার সংঘাত ভয়াবহ রুপ লাভ করেছে। ঝড়ের গতিতে কাবুলের দিকে ধেয়ে আসছে তালিবানরা। একের পর এক শহরের পতন হচ্ছে তালিবানদের হাতে। স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ আফগানিস্তান গঠনে যারা এতদিন কূটনীতির টেবিলে বসার তাগিদ দিতেন, এই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে।
বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো এই নতুন সংকটের মাঝেও সুযোগ খুঁজে চলছে। পরিবর্তিত আফগানিস্তানের পরিস্থিতির ওপর দেশগুলো সজাগ দৃষ্টি রাখছে। আফগানিস্তানে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে সম্ভাব্য সকল উপায়ই ব্যবহার করছে দেশগুলো। এই কাজে যেমন নতুন, নতুন সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তেমনি এতে হাতছানি দিচ্ছে সীমাহীন সম্ভাবনাও। নতুন আফগানিস্তানে এসব সমীকরণ মেনেই এগোচ্ছে রাশিয়া, চীন, ইরান ও তুরস্কের মতো দেশগুলো।
তবে এই দেশগুলোর তুলনায় আফগানিস্তানে নতুন করে জায়গা করে নেয়ার লড়াইয়ে ভারত পিছিয়ে আছে অনেকটাই। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পড়ে সবচেয়ে বেশি স্বার্থ জড়িয়ে যে দেশটির সেটি হচ্ছে আমাদের এই প্রতিবেশী রাষ্ট্র। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন,আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং ভূরাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষায় আফগান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিলো ভারত। তালিবান সরকারের পতনের পর আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে দিল্লি কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢেলেছে। গত দুই দশকে আফগানিস্তানে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারে সামাজিক-অর্থনৈতিক, বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় তিনশ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে ভারত।যেসব প্রকল্পের অধিকাংশেরই দখল মিত্রদের হাত থেকে বের হয়ে এখন চলে গেছে তালিবানদের হাতে। স্বাভাবিকভাবেই আফগানিস্তানে নিজেদের মিত্রদের এমন দুরবস্থায় হতাশ দিল্লি।
বিনিয়োগের বিপুল অর্থ জলে যাওয়া ছাড়াও দিল্লির হতাশ হওয়ার আরো অনেক কারণ রয়েছে। লাদাখ ও কাশ্মীরে চীন,পাকিস্তানের পর আফগানিস্তানে তালিবান শাসন ভারতের সামনে নতুন দুশ্চিন্তা হাজির করছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে অনুন্নত সম্পর্ক যে কারণে ভারতের মাথাব্যথা বৃদ্ধি করবে নিশ্চিতরুপেই।
ভারতের বিদেশনীতির অধিকারীকেরা এসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে অজ্ঞ নন। তারা সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে ভারত-তালিবান পূর্বের ইতিহাস যা বলছে, তার অনুবাদ করলে বলতে হয়, এই চ্যালেঞ্জ সফলভাবে উতরে যাওয়া তালিবান ও ভারত উভয়ের জন্যই কঠিন হবে।
ভারতের নীতিনির্ধারকদেরও এই উপলব্ধি হয়েছে। এরই প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে ভারতের তালিবাননীতিতেও। "তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা নয়" নীতি থেকে বের হয়ে আসছেন তারা। ধারণা করা হয়, ২০০৮ সালে ভারতীয় কনস্যুলেটে বোমা হামলার পর থেকেই তালিবানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে দিল্লি। দোহা চুক্তির আগে যে সম্পর্ক লুকিয়ে-চুরিয়ে চলেছে সেটা চুক্তি পরবর্তী সময়ে সামনে চলে এসেছে। তালিবান নেতৃত্ব ও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের চাপে বিষয়টি সামনে আসলেও ভারত দাবি করছে তারা আফগানিস্তানে নিজেদের বিনিয়োগ ও স্বার্থ সুরক্ষায় আফগানিস্তানের অংশিদারদের সাথে আলোচনা করছে। সেই "অংশিদার" কারা পরবর্তীতে সেটাও খোলাসা হয়েছে। ভারতের বক্তব্য, তারা তালিবানদের "জাতীয়তাবাদী" অংশের নেতাদের সাথে যোগাযোগ করছে। যাদের ব্যাপারে দিল্লি সমালোচকদের আশ্বস্ত করেছে যে, তাদের নীতি "পাকিস্তান প্রভাবিত" নয় বলে।
যেসকল উন্নয়নমূলক প্রকল্প সম্প্রতি তালিবানের হস্তগত হয়েছে সেসব বিষয়ে দিল্লি সমঝোতার নীতি গ্রহন করেছে। ভারত এইসকল প্রকল্পের অর্থ তালিবানকে রুষ্ট করে জলে ফেলতে রাজি নয়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সেগুলো বহাল রাখতে দিল্লি আগ্রহী। তালিবানরাও এতেই খুশি। তবে তালিবান-ভারত সম্পর্কে ভারত যাদের পথের কাটা বলে ভাবছে, সেই পাকিস্তানকে এড়িয়ে তালিবান কতটা স্বাধীনভাবে ভারতনীতি গ্রহন করতে সক্ষম হবে তা নিয়েই দিল্লি চিন্তিত। আর সেজন্যই তালিবানের "জাতীয়তাবাদী" অংশের সাথে ভারত আলাপে আগ্রহী হয়ে ওঠছে।
অবশ্য তালিবানের পক্ষ থেকেও সবুজসংকেত মিলেছে ভারতের। তারা আফগানিস্তানে দিল্লির উন্নয়ন প্রকল্পগুলো জারি রাখার আশ্বাস দিয়েছে। পাশাপাশি তারা যে ভারতের সাথে একটি সৌহার্দপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিতে বিশ্বাসী তাও নিশ্চিত করেছে। যদিও এনিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ বিদ্যমান রয়েছে দু'পক্ষেরই।
ভারতের আসল উদ্বেগ আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে। ৯০ এর দশকের মতো পরিস্থিতি তারা চায়না। যেই সময় কাশ্মীরকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিলো আফগানফেরত জিহাদীরা। আবারো নতুন করে একই পরিস্থিতি তৈরি যেন না হয় সেটা নিশ্চিত করতেই ভারত তালিবানের মুখোমুখি বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে ভারত তালিবানকে নিয়ে ভাবলেও তাদের মূল চিন্তা পাকিস্তানকে ঘিরে। যদি কাবুলের মসনদে তালিবান আসীন হওয়ার পড়ে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ইসলামাবাদ ছড়ি ঘোরাতে শুরু করে তাহলেই ভারতের সামনে অপেক্ষা করছে মহা বিড়ম্বনা।শত্রু রাষ্ট্র দ্বারা ঘেরাওয়ের মুখে পড়ে যাওয়া ভারতকে তখন বিনিয়োগকৃত অর্থের চিন্তা ফেলে দিয়ে ঘরের চৌকাঠের নিরাপত্তা নিশ্চিতেই বেশি মনোযোগী হতে হবে। আর সেজন্যই দিল্লিকে সংঘাতের বদলে এবার সংলাপের দিকেই ঝুঁকতে হবে।
কিন্তু নতুন পরিবেশ-পরিস্থিতি ভারতের পক্ষে কথা বলছে না। পাকিস্তান এখনো যথাসম্ভব দিল্লিকে কাবুলে নিষ্কৃিয় করে ফেলতে চাইছে। তালিবান-ভারত সম্পর্কে পাকিস্তান নিজেদের আরো প্রাসঙ্গিক করে তুলতে আগ্রহী। তালিবান-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সূচনায় নিজেদের যতবেশি করে সম্পৃক্ত করে তুলতে পারবে ইসলামাবাদ, পরবর্তীতে ঠিক ততটাই দূর্বল হয়ে পড়বে দিল্লি। সেজন্যই তালিবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান নিয়ে দারুণ শংকায় পড়েছে ভারত।
তালিবান নিজেরাও খুব একটা খুশি নয় পাকিস্তানের ভূমিকায়। বিদেশি প্রভাবমুক্ত, আরো নির্দিষ্ট করে বললে পাকিস্তানের প্রভাবমুক্ত পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে আগ্রহী তারা। পাকিস্তানের বংশবদ হয়ে ভারতের মতো বৃহৎ শক্তির সহযোগিতা হেলায় হারাতে চায়না তালিবান। তালিবান জানে ভারতের সাথে একটি উইন-উইন সম্পর্ক তাদের জন্য কতটা জরুরী। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের জনকের কালিমা মুছতে এবং আন্তর্জাতিক মহলে নতুন রাজনৈতিক শক্তির স্বীকৃতি লাভ করতে ভারতের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা তাদের অজানা নয়। চীন, রাশিয়া, ইরানের পর তাই তালিবানও ভারতের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক সৃষ্টিতে আগ্রহী হয়ে ওঠছে।
তবে সব ছাপিয়ে এই সম্পর্কে মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠতে পারে পাকিস্তান। তালিবান-ভারত সম্পর্কে পাকিস্তান যতই নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে তুলবে ততটাই হতাশ হতে হবে ভিন্ন দুই পক্ষকে। যদি এমনটা হয় তাহলে এর প্রতিক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদে ভুগতে হবে তালিবান ও ভারত উভয়কেই। অন্যথায় কিছুদিনের জন্য চিরশত্রু দুই পক্ষকে আমরা বন্ধুর অভিনয় করতেই দেখতে পাবো।
হাসিবুর রহমান
ভু-রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক
বিশ্লেষক

0 মন্তব্যসমূহ