ঈদের নামাজ পড়ার নিয়ম

ঈদের নামাজ পড়ার নিয়ম


ঈদ মুসলমানদের শ্রেষ্ঠতম ধর্মীয় উৎসব। মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর দু'টি ঈদ উদযাপন করে।এবং
ঈদের নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। বছরে দুই বার ঈদের নামাজ।

রাসুল (সা.) বলেছেন, ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ফেরেশতারা রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান এবং মুসলমানদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, হে মুসলমানগণ!তোমরা দয়ালু প্রতিপালকের দিকে এগিয়ে এসো। উত্তম প্রতিদান ও বিশাল সাওয়াব-প্রাপ্তির জন্য এগিয়ে এসো। তোমাদের রাত্রিবেলার নামাজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তোমরা সে নির্দেশ মেনে নামাজ পড়েছো। তোমাদের দিনে রোজা রাখতে বলা হয়েছিল, তোমরা সে নির্দেশও পালন করেছো, এক মাস রোজা রেখেছো। গরিব দুঃখীদের আহার করানোর মাধ্যমে নিজের প্রতিপালককে তোমরা আহার করিয়েছো। এখন নামাজ পড়ে এসব পুণ্যকর্মের প্রতিদান ও পুরস্কার গ্রহণ করো। ঈদের নামাজ পড়ার পর একজন ফিরিশতা ঘোষণা দেন, শোন নামাজ আদায়কারীরা! তোমাদের মহান রাব্বুল আলামিন মাফ করে দিয়েছেন, সকল গুনাহ থেকে মুক্ত অবস্থায় নিজ নিজ আবাসে ফিরে যাও। আজ পুরস্কার প্রদানের দিন। আকাশে এই দিনের নামকরণ করা হয়েছে ‘পুরস্কারের দিন’ (আল মুজামুল কাবির লিত তাবারানি ৬১৭, ৬১৮)।

ঈদুল ফিতরের নামাজের নিয়ত (আরবি)
নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তায়ালা রাকয়াতা সালাতি ঈদিল ফিতর, মায়া ছিত্তাতি তাকবীরাতি ওয়াজিবুল্লাহি তায়ালা ইকতাদাইতু বিহাযাল ইমাম, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।

ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম
নিয়ত করে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে হাত তুলে তাহরিমা বাঁধতে হবে। এরপর ছানা পড়েন মুসল্লিরা- সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়াতাআলা যাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।

এরপর তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ উচ্চারণ করে তাকবির বলতে হয়। প্রথম দুই বার কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু তৃতীয়বার বলে হাত বেঁধে নেন সবাই। প্রতিটি তাকবিরের পর তিনবার সুবহানাল্লাহ বলা যায় এমন সময় থেমে থাকতে হয়।তারপর আউজুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পড়ে সূরা ফাতেহার পর একটি সূরা যুক্ত করেন ইমাম। এরপর স্বাভাবিক নামাজের মতোই রুকু ও সিজদা করে দ্বিতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়াতে হয়। এবার বিসমিল্লাহ বলার পর সূরা ফাতেহা পড়ে আরেকটি সূরা মেলানো হবে। তারপর তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলার মাধ্যমে তিনটি তাকবির সম্পন্ন করতে হয়। এ সময় প্রতিটি তাকবিরের পর হাত ছেড়ে দিতে হবে এবং চতুর্থবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলে হাত না বেঁধে রুকুতে চলে যাওয়া নিয়ম। এরপর সেজদা ও আখেরি বৈঠকের পর সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ হয়।

ঈদুল ফিতরের দুই রাকাত নামাজ শেষে ইমাম মিম্বারে উঠে দুটি খুতবা দেন। ঈদের খুতবা শোনা ওয়াজিব। খুতবা শেষে সবাই মসজিদ থেকে বের হবেন।

ঈদের দিনের ইবাদতসমূহঃ 
ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করা
অনেকেই ফজরের নামাজ আদায় করে না। ঈদের জন্য ফজরের নামাজ জামাতে পড়ার গুরুত্বও দেয় না।অথচ ফজরের নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি তারা ইশা ও ফজর নামাজের মধ্যে কী আছে তা জানতে পারতো তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এ দু’টি নামাজের জামাতে শামিল হত। (সহিহ বোখারি: ৬১৫)।

ঈদের নামাজ আদায় করা
ঈদের দিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঈদের নামাজ আদায় করা। হাদিসে এসেছে, ‘নবী করিম (সা.) ঈদুল ফিতরের দিনে বের হয়ে দু’রাকাত ঈদের নামাজ আদায় করেছেন।এর পূর্বে ও পরে অন্য কোনো নামাজ আদায় করেননি। ’ (সহিহ বোখারি: ৯৮৯)।

ঈদের দিন গোসল করা
ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছছন্নতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা এ দিনে সকল মানুষ নামাজ আদায়ের জন্য মিলিত হয়। ইবনে উমার (রা.) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত যে, ‘তিনি ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।" (সুনান বায়হাকি: ৫৯২০)।

পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া
ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া হল সুন্নত। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘সুন্নত হলো- ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া। (তিরমিজি: ৫৩৩)।
ঈদের দিনে খাবার গ্রহণ
ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের নামাজ আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা এবং ঈদুল আজহার দিন ঈদের সালাতের পূর্বে কিছু না খেয়ে নামাজ আদায়ের পর কোরবানির গোশত খাওয়া সুন্নত। হজরত বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী করিম (সা.) ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে খেতেন না। ’ (তিরমিজি:  ৫৪৫)।

নতুন বা পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা
ঈদে উত্তম জামা-কাপড় পরিধান করে ঈদ উদযাপন করা। এ দিনে সকল মানুষ একত্রে জমায়েত হয়, তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত হল তার প্রতি আল্লাহর যে নিয়ামাত তা প্রকাশ করণার্থে ও আল্লাহর শোকরিয়া আদায়স্বরূপ নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করা। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ রাববুল আলামিন তার বান্দার ওপর তার প্রদত্ত নিয়ামতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন।’ (সহিহ আল জামে: ১৮৮৭)

ঈদের খুতবা শ্রবণ করা
ঈদের খুতবা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। এতে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। হজরত আবদুল্লাহ বিন সায়েব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের নামাজ শেষ করলেন, বললেন, আমরা এখন খুতবা দেব। যার ভালো লাগে সে যেন বসে আর যে চলে যেতে চায় সে যেতে পারে। ’  (আবু দাউদ: ১১৫৭)।

দোয়া ও ইস্তেগফার করা
ঈদের দিনে আল্লাহতায়ালা অনেক বান্দাকে মাফ করে দেন। মুয়ারিরক আলঈজলী (রাহ.) বলেন, ঈদের এই দিনে আল্লাহতায়ালা একদল লোককে এভাবে মাফ করে দিবেন, যেমনি তাদের মা তাদের নিষ্পাপ জন্ম দিয়েছিল। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তারা যেন এই দিনে মুসলিমদের জামাতে দোয়ায় অংশগ্রহণ করে। ’ (লাতাইফুল মায়ারিফ)।

মুসাফাহা ও মুয়ানাকা করা
মুসাফাহা ও মুয়ানাকা করার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একদা হাসান ইবনে আলী (রা.) নবী করিম (সা.)-এর নিকট আসলেন, তিনি তখন তাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং মুয়ানাকা (কোলাকুলি) করলেন। ’ (শারহুস সুন্নাহ)।
ফিতরা দেয়া
রমজান মাসে সিয়ামের ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণার্থে এবং অভাবগ্রস্তদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাতের পূর্বে নির্ধারিত পরিমাণের যে খাদ্য সামগ্রী দান করা হয়ে থাকে, শরিয়তের পরিভাষায় তাকেই জাকাতুল ফিতর বা ফিতরা বলা হয়। হাদিসে বর্ণিত, ‘হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদের নামাজে যাওয়ার পূর্বে ফিতরা আদায় করার আদেশ দিলেন। ’ (সহিহ বোখারি: ১৫০৩)।

ইয়াতিম ও অভাবীকে খাবার খাওয়ানো
ইয়াতিমের খোঁজ-খবর নেয়া, তাদেরকে খাবার খাওয়ানো এবং সম্ভব হলে তাদের নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেয়া। এটা ঈমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকিন, ইয়াতিম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে। (সূরা আদ দাহর: ৮)।

আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেওয়া
ঈদের সময় বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেওয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ তৈরি হয়। এ সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে আখেরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে। ’ (সহিহ বোখারি: ৬১৩৮)।

প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর নেওয়া
ঈদের সময় প্রতিবেশীর হক আদায়ের সুযোগ তৈরি হয়। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘তোমরা ইবাদত কর আল্লাহর, তার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সঙ্গে, নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে, ইয়াতিম, মিসকিন,  প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে, যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী। ’ (সূরা আন নিসা: ৩৬)।

মনোমালিন্য দূর করা
জীবন চলার পথে বিভিন্ন পর্যায়ে কারো কারো সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। ঈদের সময় পারস্পরিক মনো-মলিন্য দূর করা ও সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উত্তম সময়। হাদিসে এসেছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে তার ভাইকে তিন দিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে। তাদের অবস্থা এমন যে দেখা সাক্ষাৎ হলে একজন অন্য জনকে এড়িয়ে চলে। এ দুজনের মাঝে ওই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে প্রথম সালাম দেয়। ’ +সহিহ মুসলিম: ৬৬৯৭)।

আনন্দ প্রকাশ  করা
ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা যেখানে সুস্থ বিনোদনের সুযোগ রয়েছে। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদের দিন আমার ঘরে আগমন করলেন, তখন আমার নিকট দু’টি ছোট মেয়ে গান গাইতেছিল, বুয়াস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে। তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। ইতোমধ্যে আবু বকর (রা.) ঘরে প্রবেশ করে এই বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজির ঘরে শয়তানের বাঁশি? রাসূলুল্লাহ (সা.) তার কথা শুনে বললেন, ‘মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন। ’ (সহিহ বোখারি: ৯৫২)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ