কথার কপচপানি নাকি কার্যকরী ভূমিকা; কপের ফলাফল কি? - Opinion -


কপ-২৬ এ বাজছে শেষের সুর। শেষার্ধে অবস্থান করছে জলবায়ু সম্মেলন। গ্লাসগো থেকে বিশ্ব কি পেলো আর কি হারালো তা নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। প্রত্যাশার কতটা পূরণ হলো, ঘাটতি কতটা রয়ে গেলো তারই ফলাফল বের করার চেষ্টা চলছে। বিশ্বনেতাদের প্রতিশ্রুতি, পরিবেশকর্মীদের প্রত্যাশা আর বাস্তবতার ফারাক- চলছে সমন্বিত হিসেবের প্রচেষ্টা। 

প্যারিস চুক্তি-পরবর্তী সময়ে এবারের জলবায়ু সম্মেলনকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছিল। ২০২০ সালে প্যারিস-চুক্তি থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার বেরিয়ে যাওয়া জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলার লড়াইয়ে যে স্থবিরতার সূচনা করেছিলো তা বাইডেন প্রশাসনের প্যারিস-চুক্তিতে ফিরে আসায় কেটে গেছে মোটামুটি। আর সে কারণেই এবারের জলবায়ু সম্মেলন নিয়ে প্রত্যাশার পারদও ছিল উঁচুতে। 

বিশ্বনেতারাও সে প্রত্যাশার দায় মেটানোর তাড়না অনুভব করেছেন। বেশকিছু উদ্যোগের ঘোষণা এসেছে তাদের তরফে। যদিও পরিবেশকর্মীদের দাবি, এসব উদ্যোগ ছয়বছর আগের প্যারিস-চুক্তিরই অস্থিচর্মমাত্র। নতুন কিছু নিয়ে আসেনি এবারের জলবায়ু সম্মেলন। পুরনো জিনিসই নতুন মোড়কে আমদানী করছেন বিশ্বনেতারা। চমকজাগানিয়া উদ্যোগ ও অবাস্তব-অসম্ভব পরিকল্পনা পেশ করে মানুষকে মোহগ্রস্ত করে রাখতে চাইছেন তারা। ফলে পরিবেশকর্মীরা নেমে আসছেন রাস্তায়।

এবারের সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ যেসব সমঝোতা হয়েছে সেগুলোর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে অরণ্য উজাররোধে শতাধিক বিশ্বনেতার ঐকমত্যে পৌঁছানো। যাদের মাঝে পরিবেশবিদ্বেষী বলে সমালোচিত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোও রয়েছেন। কপ-২৬ এ গৃহীত এটিই সর্বপ্রথম বড় কোন পদক্ষেপ। বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ কমাতে নিরাপদ সবুজায়নের লক্ষ্যে গৃহীত এই উদ্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় অনেকটাই এগিয়ে রাখবে মানুষকে। তবে খারাপ খবর হচ্ছে, এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে ভারত ও বাংলাদেশ। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট সম্ভাব্য সংকটের বড় ভুক্তভোগী হবে দেশ দুটি। যার আভাস ইতোমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। 

অরণ্য উজাররোধে বিশ্বনেতাদের অঙ্গিকার ইতিবাচক হলেও এই উদ্যোগ নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন প্রস্তুত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বন প্রতিরক্ষায় যে সময়সীমা তারা নির্ধারণ করেছেন তা অবাস্তব। দেশগুলো শুধু সস্তা হাততালি কুড়িয়ে জলবায়ু পীড়িত মানুষকে গ্রিনওয়াশ করতে চাইছে। আর বিশ্লেষকদের এই ধারণা যে একেবারে অবান্তর নয়, এর প্রমাণও ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়ার শাসনযন্ত্রের কিছু অংশও এনিয়ে নিজেদের নারাজী প্রকাশ করেছেন। যদিও অরণ্য উজাররোধে বিনিয়োগকৃত ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের তহবিলে তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে এর সাথে সাথে তারা এটা জানিয়ে দিতেও ভুলেননি যে, তহবিল তাদের জন্য পর্যাপ্ত না হলে তারা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম স্থগিত রাখবেন না। অর্থাৎ বন উজাররোধে দৃঢ় পদক্ষেপ নেবেন না। তাই পুরো বিষয়টি নিয়েই তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। 

জলবায়ু বিপর্যয়রোধে অরণ্য উজাররোধই  একমাত্র সমাধান নয়। এটা কেবলমাত্র সমস্যা থেকে উত্তরণের একটি ধাপ মাত্র। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক যে ঝুঁকির সৃষ্টি হচ্ছে তা মোকাবেলার দায় কেবলমাত্র বন উজাররোধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এই দেশগুলোর কাঁধেই নয়। বরং উন্নত, উৎপাদনমুখী দেশগুলোর কাঁধেও এর অনেকখানি দায় বর্তায়। 

আরও পড়ুন:

আর সেই দায় কতটা তা অক্সফামের হয়ে ইনস্টিটিউট অফ ইউরোপীয়ান এনভায়রনমেন্টাল পলিসি ( আইইইপি) ও স্টকহোম এনভায়রনমেন্ট ইনস্টিটিউটের (এসইআই) যৌথ গবেষণায় দেখা গিয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি আমাদের জানাচ্ছে, বিশ্বের ৫০ শতাংশ দরিদ্র মানুষ মাথাপিছু যতটা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে, উন্নত বিশ্বের ধনী লোকজনের বিলাসিতা করে তারচেয়ে ৩০ গুণ বেশি! এছাড়াও গত ২ জুন ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড এন্ড ডেভেলপমেন্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের প্রায় ৫০ শতাংশ করছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। আর যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, জাপান, কানাডা ও ইইউভুক্ত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ৮০ শতাংশ। এই বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ শিল্পোন্নত দেশগুলোর উৎপাদনে অসুস্থ প্রতিযোগীতারই প্রতিফলন। যারফলে ভুগতে হচ্ছে অনুন্নত, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে ভারত, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, মালদ্বীপ ও চীনের মতো দেশের জনগণ। ধনী দেশগুলোর অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে গরীব দেশের অশিক্ষিত-অসহায় মানুষজনকে। 

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, যদি ধনী,শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণে এমন স্বেচ্ছাচারীতা বিদ্যমান থাকে তাহলে প্যারিস-চুক্তি মোতাবেক কার্বন নিঃসরণে নেট জিরোর অভীষ্ট লক্ষ্য দূরে থাক,শতাব্দী শেষে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রির নিচে রাখাই দায় হয়ে পড়বে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা তখন ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যাবে। যা প্যারিস-চুক্তির ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রাকেই শতাব্দী শেষে হাস্যরসের বস্তু বানিয়ে ফেলবে। অথচ, এবারের সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ নিয়ে স্পষ্ট কোন রুপরেখাই বর্ণিত হয়নি। 

তবে আশার কথা হচ্ছে, কপ-২৬ এ যেসকল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যেসব উদ্যোগ বিশ্বনেতারা নিয়েছেন তা বাস্তবায়িত হলে এখনো অর্ধ শতাব্দীর আগে নেট জিরোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব বলে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা জানিয়েছে। গ্লাসগোর চলমান জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন শতাব্দী শেষে বৈশ্বিক তাপমাত্রাকে প্যারিস-চুক্তির লক্ষ্যমাত্রার অনুকূলেই রাখবে। ফলে আশার বেলুন যে একেবারেই চুপসে গেছে তা-ও বলা যাচ্ছে না। 

ধনী দেশগুলোর পরিবেশবিধবংসী এসব কাজকারবার নৈতিকভাবেই তাদের ওপর বাড়তি দায় চাপিয়েছে। ধেয়ে আসা জলবায়ু বিপর্যয়রোধে তাদের যে নেতৃত্ব দিতে হবে সেটা আগে থেকেই বলা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি দিন-দিন নাজুক হওয়া সত্যেও শিল্পোন্নত দেশগুলো এতে গা করছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহাররোধ, কার্বন নিঃসরণে নেট জিরোর লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য দরকার বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক বিনিয়োগ। স্বাভাবিকভাবেই সরকারি-বেসরকারী বৈদেশিক বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল উন্নয়নশীল দেশগুলোর এই লড়াইয়ে একা নামা কঠিন।সেজন্য পাশে উন্নত দেশগুলোরও দরকার, দরকার জলবায়ু তহবিলেরও। দূঃখের বিষয় হলো, এ'ব্যাপারে উন্নত বিশ্বের অগ্রগতি একেবারেই ধীর। নূন্যতম ১০০ বিলিয়ন ডলারের যে তহবিল নির্ধারণ করা হয়েছিলো, তা-ও অর্জিত হয়নি। এবারের কপ-২৬ এও এ'নিয়ে অগ্রগতি একেবারেই সামান্য। তাছাড়া কপ-২৬ এর প্রাক্কালে জাতিসংঘ ঘোষিত অনুন্নত দেশগুলোর জলবায়ু অভিযোজনে ২০৩০ সাল নাগাদ ৩০০ বিলিয়ন ডলারের চাহিদা পূরণেও ধনী দেশগুলোর অনীহা লক্ষ্য করা গেছে। জাতিসংঘ হুশিয়ার করে বলছে, প্রশমনের লক্ষ্যমাত্রা যদি আগামী ৯ বছরে পূর্ণ না করা হয় তাহলে অর্ধ শতাব্দী নাগাদ ধনী দেশগুলোর খরচের খাতায় যোগ হবে ৫০০ বিলিয়ন ডলার। বোঝাই যাচ্ছে, অনুন্নত দেশগুলোর পক্ষে অবকাঠামো উন্নয়ন এড়িয়ে জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় এই বিশাল অংকের বোঝা বহন করা কঠিন। জাতিসংঘের ঘোষণা করা টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনুন্নত দেশগুলোর ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন থেকে ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়নের যে চাহিদা, সেটা পূরণে শিল্পোন্নত, উৎপাদনমুখী দেশগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে। এর অন্যথা হলে জলবায়ু-ভেলকি বাড়বে বৈ কমবে না। 

নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে এবারের সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো আদতে নিঃস্বার্থ নয়। যারফলে জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় যে সমন্বিত পদক্ষেপের প্রত্যাশা বিশ্ববাসী তাদের নেতাদের কাছে করেছিলেন তা পূরণ হয়নি। মিথেন নিঃসরণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বে ৯০ টির বেশি দেশ ঐক্যবদ্ধ হলেও স্বার্থের অনুকূলে না হওয়ায় এ'থেকে রাশিয়া, ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রও যে এই সিদ্ধান্ত নিজেদের স্বার্থত্যাগ করে নিয়েছে এমনটি ভাবারও কারণ নেই। দেশটি কেবল জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক  গ্যাস নিঃসরণেরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, মাংস ও দুগ্ধজাত উৎস থেকে নিঃসৃত গ্যাসকে এই আওতার বাইরে রেখেছে। অথচ গবাদিপশুর মলমূত্র থেকেই মিথেনের উৎপাদন অধিক হচ্ছে। 

আরও পড়ুন :

এছাড়াও পরিবেশবিনাশী জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে পারমাণবিক জ্বালানির মতো নবায়নযোগ্য শক্তি যখন পরিবেশবিদদের নজর কাড়ছে, হয়ে ওঠছে পরিবেশবান্ধব জ্বালানীর ভবিষ্যত তখন জার্মানী ও নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত দেশগুলো করছে এর বিরোধিতা। কপ-২৬ এর সভাপতি রাষ্ট্র যুক্তরাজ্য জীবাশ্ম জ্বালানির অনুসন্ধান চালাচ্ছে সাগর-সমুদ্রে। চীন বাড়িয়েছে এর উৎপাদন। জি-২০ দেশগুলো এই খাতে ভর্তুকি পরযন্ত দিচ্ছে। বিপরীতে যদিও শক্তিশালী অর্থনীতির অধিকারীক দেশগুলো কয়লাবিদ্যুতের মতো জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্পগুলোতে ২০৪০ সালের মধ্যে অর্থায়ন বন্ধ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ২০ টি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিদেশে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন বন্ধের অঙ্গিকার করেছেন।  তথাপি সমন্বিত উদ্যোগের অভাব ও উৎপাদন বৃদ্ধির অসুস্থ প্রতিযোগীতা বিশ্বকে ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। আর কপ-২৬ সম্মেলনে এই বিষয়টির ওপরই সর্বাধিক গুরুত্ব বিশ্ব প্রত্যাশা করেছিলো। 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে ধরিত্রীর সুরক্ষায় সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে বহুমুখী ব্যয়বহুল পরিকল্পনা। কিন্তু যেটার অভাব রয়ে গেছে, সেটা হচ্ছে সমন্বিত উদ্যোগ। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রযুক্তি ও ব্যবসায় খাতগুলোর সরকারি-বেসরকারি যেমন সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন, তেমনি এসবের বাস্তবায়নে বিশ্বনেতাদের মাঝেও প্রয়োজন সমন্বিত বোঝাপড়া, সমঝোতা-সহযোগীতা। যেটার অভাব বিশ্ব টের পেয়েছে ছয়বছর আগের প্যারিস জলবায়ু চুক্তির সময়ই। ছয়বছর বাদে সেই একই বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে পৃথিবী। কপ-২৬ এও এই বিষয়টির মুখোমুখি হতে হচ্ছে বিশ্ববাসীকে। যদি এই বিষয়ের সুরাহা অধরা থেকে যায়, তাহলে আমাদের সবুজ, সমৃদ্ধ আগামী  বিবর্ণ হতেই থাকবে।

হাসিবুর রহমান 

লেখক ও ভু-রাজনৈতিক বিশ্লেষক 


 আরও পড়ুন: 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ