আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি,বিশ্ব মানবতার অগ্নি মশাল, রক্তাত্ত সলঙ্গা বিদ্রোহের মহানায়ক,ভাষা আন্দোলনের সিংহ পুরুষ , মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি প্রবাদ পুরুষ, সমাজ সংস্কারক মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের আজ ১২১ তম জন্মজয়ন্তী ।
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন-শোষণ থেকে ভারত উপমহাদেশের মুক্তি। ভারত-পাকিস্তান আন্দোলন। পাকিস্তানের উপনিবেশিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও বল্গাহীন শোষণের কবল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ।
উপরোক্ত সুদীর্ঘকালীন ইতিহাসে গণমানুষের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক-শিক্ষা-সাং স্কৃতিক মুক্তির মহাসংগ্রামে যারা মহান নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন; জনগণমনন্দিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন তারা হলেনঃ ‘মহাত্মা গান্ধী’ মোহনদাশ করমচাঁদ, পন্ডিত জওয়াহের লাল নেহেরু, স্যার সৈয়দ আহমদ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, শেরে বাংলা ফজলুল হক, বিশ্বকবি- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মাস্টার দা সূর্যসেন, সীমান্তগান্ধী খান আবদুল গাফফার খান, কাশ্মীর শার্দুল শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ।
এমনই একজন ঐতিহাসিক খেতাবধারী ছিলেন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ।
মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ছিলেন হজরত মা ফাতেমা রাদিয়াহু তালা আনহা ও হজরত আলী রাদিয়াহু তালা আনহুর পুত্র হজরত হুসেন রাদিয়াহু তালা আনহুর পুত্র হজরত জয়নুল আবেদীন( র.)এর সরাসরি বংশ ধর।
মাওলানা তর্কবাগীশ ২৭ নভেম্বর ১৯০০ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার রশীদাবাদ (তারুটিয়া) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হযরত সৈয়দ আবু ইসহাক (র.) ছিলেন আধ্যাত্মিক পুরুষ। তাঁর পূর্ব পুরুষ হযরত শাহ্ সৈয়দ দেওয়ান দরবেশ মাহমুদ বাগদাদী (র.) ছিলেন বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (র.)-এর উত্তর পুরুষ।
হযরত শাহ্ সৈয়দ দেওয়ান দরবেশ মাহমুদ বাগদাদী (র.) ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে আগমন করেন।
মাওলানা তর্কবাগীশ ১৯১৯ সালে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে খেলাফত আন্দোলনে জরিয়ে পড়েন।পরে এন্ট্রান্স পাশ করেন।
১৯২২ সালে তৎকালীন কংগ্রেস নেতা বিপ্লবী মাওলানা তর্কবাগীশ উপমহাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্ত সিঁড়িঁ ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দান করেন।
তাঁর নেতৃত্বে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সেদিন সলঙ্গা হাটে বিদ্রোহে উত্তাল সাগর তরঙ্গের মতো আছড়ে পরে।
ব্রিটিশ পুলিশের নির্বিচার গুলী বর্ষণে সেদিন সরকারি হিসাবেই সাড়ে চার হাজার মানুষ নিহত হয় । ব্রিটিশ পুলিশের নির্যাতনে মারাত্মক আহত হয়ে তিনি কারাবরণ করেন।
১৯২৩ সালে ব্রিটিশের কারাগার থেকে মুক্ত হন তিনি। পরবর্তিতে লাহোরে বিখ্যাত এশায়েতুল ইসলাম কলেজে ভর্তি হন।
এ সময় মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে রচিত অশ্লীল গ্রন্থ "রঙ্গীলা রসুল" এবং আড়িয়া (আর্য) সমাজের শুদ্ধি অভিযানের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংঘটিত করে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন।
সারা ভারতব্যাপী এই আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয় রঙ্গীলা রসুল বাজেয়াপ্ত করতে এবং এরপর তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানও বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় অনেক বাহাস অনুষ্ঠিত হয় তখন তাঁকে সাধারণ জনগন তর্কবাগীশ উপাধিতে ভূষিত করেন।
পরবর্তীতে তিনি বিখ্যাত দেওবন্দ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন।
জমিদারী প্রথা বিলুপ্তি জন্য " বঙ্গ রায়ত খাতক সমিতি গঠন করেন "।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন এই সমিতির সভাপতি এবং মাওলানা তর্কবাগীশ ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। দেশব্যাপী এই সমিতির ব্যাপক আন্দোলনের ফলেই গঠিত হয় ঐতিহাসিক "ঋণ সালিশী বোর্ড"।
এ সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সভাপতিত্বে যে ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি গঠিত হয় মাওলানা তর্কবাগীশ পালন করেন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব।
অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪৬ সালে এম এল এ নির্বাচিত হন ।
মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবীতে সংগ্রামরত ছাত্রদের উপর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলী বর্ষণের প্রতিবাদে ব্যবস্থাপনা পরিষদে (সংসদে) মাওলানা তর্কবাগীশ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠেন।
একাকীই অপরিমেয় বলিষ্ঠতার সাথে তিনি অধিবেশন মুলতবী করে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার প্রস্তাব করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি মাওলানা তর্কবাগীশ পরিষদে প্রধান মন্ত্রী নূরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। সেই সঙ্গে মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করে বিরোধী দল গঠন করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি মুসলিম লীগ সরকার নিজের পতন ঠেকাতে মাওলানা তর্কবাগীশকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে এবং তাঁকে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে ১৮ মাস জেলে বন্দি করে রাখে ।
আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য হিসাবে পাকিস্তান গণ পরিষদে ১৯৫৫ সালের ১২ আগস্ট তিনি প্রথম বাংলায় বক্তৃতা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন ।
বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করার ব্যাপারে তাঁর অনমনীয় দৃঢ়তার দরুণ ১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারি পার্লামেন্টের অন্যতম ভাষা হিসাবে বাংলা স্বীকৃতি লাভ করে।
বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব তিনিই প্রথম করেন। ১৯৫৬ সালে পূর্ব বাংলার নাম পূর্ব পাকিস্তান করার তীব্র বিরোধীতাও তিনিই প্রথম করেন।
১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাওলানা তর্কবাগীশ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তখন জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সুত্রপাতও তিনি ঘটান। বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে থেকে ১৪৪ ধারা অমান্য করে যে মিছিল বের হয় তাতে নেতৃত্ব দেন মাওলানা তর্কবাগীশ। সেটাই ছিল গণ অভুত্থানের প্রথম আইন অমান্য তৎপরতা।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় পরিষদের (জাতীয় সংসদে ) প্রথম সভাপতি হিসাবে মাওলানা তর্কবাগীশ সর্বপ্রথম বাংলায় যে সংসদীয় কার্যপ্রণালী প্রবর্তন করেন তা আজও চালু আছে।
স্বাধীনতার পর মাদ্রাসা শিক্ষা পুনরায় চালু করা হয় মাওলানা তর্কবাগীশের একক উদ্দোগে।
শুধু তাই নয়,বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত রুপে গড়ে তোলেন।
ইসলামি ফাউন্ডেশনেরো তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। রেডিও টেলিভিশনে বহিঃবিশ্ব কার্যক্রমে আরবি অনুষ্ঠান প্রচারো শুরু হয় তারই উদ্দোগে। এছাড়া রেডিও এবং টেলিভিশনে আজান ও কুরআন তেলাওয়াতের নিয়মো চালু করেন তিনি।
মাওলানা তর্কবাগীশ রচিত "শেষ প্রেরিত নবী" "সত্যার্থে ভ্রমণ" "সত্যার্থ প্রকাশে সত্যার্থ" "সমকালীন জীবন বোধ" "স্মৃতির সৈকতে আমি" ও "ইসলামের স্বর্ণ যুগের ছিন্ন পৃষ্ঠা" উল্লেখযোগ্য বই৷
এছাড়া তিনি রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কারমূলক অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
১৮৮৬ সালের ২০ আগষ্ট
ভাষা আন্দলনের সিংহ পুরুষ, সাবেক আওয়ামী লীগ সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি প্রবাদ পুরুষ, মাওলানা তর্কবাগীশ পরলোক গমন করেন।
লেখকসৈয়দ হাদি তর্কবাগীশ
আরও পড়ুন:
0 মন্তব্যসমূহ