জন্ডিস কি? : জন্ডিসের কারণ ও লক্ষণ:জন্ডিসের খাবার - Health -

জন্ডিস কি? : জন্ডিসের কারণ ও লক্ষণ:জন্ডিসের খাবার - Health  -

জন্ডিস কি?
জন্ডিস বলতে সাধারণত লিভারের প্রদাহজনিত সমস্যাকেই বোঝানো হয়।জন্ডিস হলে রক্তে বিলরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়। এতে মানুষের শরীরের চামড়া বা ত্বক, স্ক্লের বা চোখের সাদা অংশ ও অন্যন্য মিউকাস ঝিল্লি হলুদ হয়ে যায়। জন্ডিস বলতে নির্দিষ্ট কোন রোগকে বোঝায় না, আসলে জন্ডিস হলো রোগের উপসর্গ বা লক্ষণ। ভাইরাস থেকে শুরু করে নানা ধরনের ওষুধ, অ্যালকোহলের কারণে লিভারে প্রদাহ হতে পারে। 

জন্ডিসের লক্ষণ:

-শারীরিক দুর্বলতা।

-ক্ষুধামন্দা।

-চোখ ও প্রসাবের রং হলুদ হয়ে যাওয়া। 

-জ্বর জ্বর অনুভূতি কিংবা কাঁপানি দিয়ে জ্বর আসা।

-বমি বমি ভাব অথবা বমি।

-মৃদু বা তীব্র পেট ব্যথা।

-অনেকসময় পায়খানা সাদা হয়ে যাওয়া।

-যকৃত শক্ত হয়ে যাওয়া।

-চুলকানি।

জন্ডিসের কারণ : জন্ডিসে করণীয়

জন্ডিসের কারণকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। ১) হেপাটোসেলুলার ২) অবস্ট্রাকশন ) হেমোলাইটিক এনিমিয়া।

হেপাটোসেলুলার: আমাদের দেশের মানুষের জন্ডিস হওয়ার শতকরা ৭০ ভাগ কারণ হচ্ছে ভাইরাল হেপাটাইটিস। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরাসের সংক্রমণে যকৃতে প্রদাহ সৃষ্টি হওয়াকে বলা হয় ভাইরাল হেপাটাইটিস।এদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সি’র সংক্রমণে যকৃতে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে জন্ডিস ভালো হলে যাওয়ার পরও নিয়মিত যকৃত পরীক্ষা করানো উচিত।হেপাটাইটিস এ এবং হেপাটাইটিস ই ভাইরাস ছড়ায় দুষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে। আর হেপাটাইটিস বি, সি এবং ডি ছড়ায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত বা রক্ত উপাদান গ্রহণের মাধ্যমে। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সুঁচ ব্যবহার করলেও এই ভাইরাস ছড়ানো সম্ভব। এদের মধ্যে হেপাটাইটিস এ এবং হেপাটাইটিস বি’র প্রতিষেধক টিকা পাওয়া যায়। তবে টিকা দিলেও ভাইরাল হেপাটাইটিসের ঝুঁকি পুরোপুরি কমে না। স্থায়ীভাবে হেপাটাইটিস এ এবং হেপাটাইটিস বি’র ঝুঁকি এড়াতে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

অবস্ট্রাকশন : শরীরের লোহিত রক্ত কণিকাগুলো ভেঙে বিলিরুবিন তৈরি হয়। এই বিলিরুবিন যকৃতে প্রক্রিয়াজাত হয়ে পিত্তরসের সঙ্গে মিশে পিত্তনালীর মাধ্যমে পরিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করে। সবশেষে পায়খানার সঙ্গে তা শরীর থেকে বের হয়ে যায়।পিত্তনালী, পিত্তথলি, অগ্ন্যাশয়, গল ব্লাডারে পাথর বা টিউমারের কারণে বিলিরুবিনের এই সঞ্চালন প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়, ফলে জন্ডিস হয়।

হেমোলাইটিক এনিমিয়া: রক্তকণিকা স্বাভাবিকের তুলনায় দ্রুত ভেঙে গেলে বা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণে জন্ডিস হওয়াকে হেমোলাইটিক এনিমিয়া বলা হয়। এ ধরনের জন্ডিসের ক্ষেত্রে চোখের সাদা অংশ হলুদ হওয়ার পাশাপাশি চোখের পাতার ভেতরের অংশ সাদা হয়ে যেতে

জন্ডিসের খাবার / জন্ডিসের সাথে খাবারের সম্পর্কঃ 

আমাদের প্রথাগত বিশ্বাস হচ্ছে-জন্ডিস হলেই বেশি বেশি পানি খেতে হবে। খেতে হবে বেশি করে আখের রস, ডাবের পানি, গ্লকোজের সরবত ইত্যাদিও। আসলে ব্যাপারটি কিন্তু এরকম নয়। জন্ডিস রোগীকে সাধারণ মানুষের মতোই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খেতে হবে। সমস্যা হতে পারে স্বাভাবিকের চেয়ে কম পানি খেলে, কারণ সে ক্ষেত্রে একিউট কিডনি ইনজুরি বা কিডনি ফেইলিওর দেখা দিতে পারে। জন্ডিসের রোগীরা অনেক সময়েই বমি বা বমি-বমিভাব এবং খাবারে অরুচির কারণে যথেষ্ট পরিমাণে পানি এবং অন্যান্য খাবার খেতে পারেন না। সেক্ষেত্রে রোগীকে শিরায় স্যালাইন দেওয়া জরুরি। বেশি বেশি পানি বা তরল খেলে প্রসাবের রং অনেকটাই হালকা বা সাদা হয়ে আসে বলে জন্ডিসের রোগীরা প্রায়বেশি বেশি তরল খাবার খেয়ে থাকেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে-এতে জন্ডিস কমে না। ধরা যাক, এক বালতি এবং এক গ্লাস পানিতে এক চামচ করে হলুদ রং গুলিয়ে দেওয়া হলো। গ্লাসের চেয়ে বালতির পানি অনেক কম হলুদ দেখালেও আসলে কিন্তু গ্লাস আর বালতি দুটোতেই হলুদ রঙের পরিমাণ সমান। তেমনি বেশি বেশি পানি খেলে ঘন-ঘন প্রসাব হয় বলে তা কিছুটা হালকা হয়ে এলেও রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ এতে বিন্দুমাত্রও কমে না। জন্ডিসের রোগীর এমনিতেই তার রোগের কারণে খাওয়ায় অরুচি, বমি বা বমিভাব এসব থাকতে পারে। আর তার সঙ্গে যদি এই উটকো ঝামেলা যোগ হয়, তাতে যে রোগীর স্বাভাবিক খাদ্য ও পানি গ্রহণ ব্যাহত হবে, সেটা তো বলাবাহুল্য। আখের রস আমাদের দেশে জন্ডিসের একটি বহুল প্রচলিত ওষুধ। অথচ সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাস্তার পাশের যে দূষিত পানিতে আখ ভিজিয়ে রাখা হয়, সেই পানি থেকেই অনেক সময় আখের রসে এবং তারপর ওই রস থেকে হেপাটাইটিস এ বা ই ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়াতে পারে। আমাদের আরেকটি প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে, জন্ডিসের রোগীকে হলুদ দিয়ে রান্না করা তরকারি খেতে দেওয়া যাবে না, কারণ এতে রোগীর জন্ডিস বাড়তে পারে। আসল কথা হলো-রক্তে বিলিরুবিন নামক একটি হলুদ পিগমেন্টের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণেই জন্ডিস দেখা দেয়; কিন্তু এর সঙ্গে খাবারের হলুদের কোনো ধরনের যোগাযোগই নেই। একইভাবে জন্ডিসের রোগীকে তেল-মসলা না দিয়ে শুধু সিদ্ধ খাবার খেতে দেওয়ারও কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এসব রোগীর এমনিতেই খাবারে অরুচি দেখা দেয়। তার ওপর এ ধরনের খাবার-দাবার রোগীদের উপকারের চেয়ে অপকারই করে বেশি। তাই জন্ডিসের রোগীকে সবসময় এমন খাবার দেওয়া উচিত, যা তার জন্য রুচিকর, যা তিনি খেতে পারছেন। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের খুব সাবধান থাকা উচিত। এ সময় মায়েরা প্রায়ই বাইরের খাবার, এটা-সেটা খেয়ে থাকেন, যা থেকে তারা অনেক সময়ই হেপাটাইটিস ই ভাইরাসজনিত জন্ডিসে আক্রান্ত হন। আর গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে যদি হেপাটাইটিস ই হয়, তবে তা থেকে মা ও গর্ভের শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি। জন্ডিসের রোগীদের সঙ্গে একই প্লেট-বাসন বা গ্লাসে খাবার বা পানি খাওয়া যাবে কি-না, এটি জন্ডিস রোগীর আত্মীয়-স্বজনের একটি বড় প্রশ্ন। যেসব ভাইরাসের মাধ্যমে একিউট হেপাটাইটিস জনিত জন্ডিস হতে পারে, তাদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ও সি ছড়ায় রক্তের মাধ্যমে। আর হেপাটাইটিস এ ও ই ভাইরাস দুটি খাদ্য ও পানিবাহিত হলেও, এই দুটি ভাইরাসের কারণে রোগীর যতদিনে জন্ডিস দেখা দেয়, তখন তার কাছ থেকে আর ওই ভাইরাস দুটি ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে না বললেই চলে।

অধ্যাপক ডা. মামুন-আল-মাহতাব (স্বপ্নীল)

লেখক : অধ্যাপক ও ডিভিশন প্রধান

ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়


আরও পড়ুন:

*যৌন মিললের ইসলামিক নিয়ম 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ