বুর্জোয়া য়্যুকেলিপ্টাস:শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ


বুর্জোয়া য়্যুকেলিপ্টাস

বর্ষাকাল। কিন্তু আকাশে ছিল না মেঘ। মধ্যশাওনে লাগাতার পাঁচদিন বিরতিহীন বৃষ্টিপাতের পর এক অখণ্ড দিনভর তেজী সূর্য্যের আলোকোজ্জ্বল অবকাশ।ঘরের মেঝেতে জমিয়ে রাখা ঠাসা সিদ্ধধানের সমাবেশ ভাঙতে ভীষণ ব্যস্ত নড়াইলের গেরস্তবধুরা। হবুখালী গ্রামের পাশ দিয়ে সুনশান পরিষ্কার আকাশ-মাথায় ছুটছে শহর অভিমুখে বিরতিহীন মিনিবাসটি। যুবকটি বসেছে বামপাশের জানালা ঘেঁষে। ডানে প্রতিবেশী মেয়ে শান্তা। আকস্মিক সজোর ব্রেক কষে চালকটি।হুড়মুড় অবস্থা-কী হল! কী হল? চিৎকার করে ওঠে যাত্রীরা। শরীরের সবটুকু শক্তি পায়ে প্রয়োগ করেও পাগলী মেয়েটিকে শেষরক্ষা করতে পারল না চালকটি!একেবারেই থেতলে গেল। হাড্ডি মাংশ মগজ রক্তে জবুথবু। এবড়ো খেবড়ো ক'টি ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল বাসটি। হুড়হুড় করে জনতার ব্যারিকেড ঘিরে ধরল গাড়িটিকে। যুবকটির তাড়া। মনটা তার বিষন্ন হয়ে গেল। নিহত মেয়েটির জন্য নয়, আরো বেশি দেরি হবার আশঙ্কায়।চারদিকে চিৎকার শুনতে পেল সে---ধর শালাকে ধর---মার!সেও স্বগতোক্তি করল-ধ্যৎ শালার------
অসহায় চালকটি তাকায় ভীত খরগোশের মত। সুযোগ খোঁজে পালাবার। কেন পালাবে? বাঁচতে চায়। দোষ কার? মেয়েটির। কিন্তু কেউ কিছুই বুঝতে চাইবে না।উন্মত্ত পাশবিকতায় মেতে ওঠবে সবাই। গণপিটুনির গণতান্ত্রিক কাজে অংশ নেবে জনতা। শান্তা মেয়েটি বলল, মেয়েটি মারাই গেল! যুবকটি নির্লিপ্ত। এসব রক্ত-মুত্যু কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। চালকটি পালাতে সক্ষম হয়েছে। আপাতত আর কোন বিপত্তি নেই ভেবে খানিকটা খুশিই হল সে। সামনে উঁকি দিল।প্রচণ্ড ভীড়। নাহ্ অপেক্ষা করতে হবে। বিরক্তি বেড়েই চলল। নিরুপায় হয়ে আত্মমগ্নতায় বিলীন হতে চাইল।চোখে ভেসে ওঠলো জেলা কারাগারে কমরেড জাকির ভাইয়ের বন্দিমুখ। আজ রাতেই অপারেশন।
যুবকটি নিষিদ্ধ ঘোষিত সর্বহারা পার্টির সদস্য। সক্রিয় গোপন ক্যাডার। শান্তা ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্রী।যুবকটিকে ভালবাসে। কিন্তু যুবকটি বাসে কিনা বলেনি।এসবে তার আগ্রহ নেই। সে বিপ্লবী।সাম্যবাদই তার প্রেম।ধনিক, জোতদার আর প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সযগ্রামে মরণপণ লিপ্ত সে। ব্যাংক লুট আর থানা লুট করে যোগান দিতে হবে বিপ্লবের অর্থ আর অস্ত্র। এই তো তার কাজ। লাল গোলাপ শুঁকে দেখবার অবকাশ কি বিপ্লবীদের থাকতে হয়। সে শোষিত, বঞ্চিত আর শ্রমিকশ্রেণির তথা প্রলেতারিয়েতের প্রতিনিধি। প্রেমিকার নয়। শান্তা ধাক্কা দিয়ে জানতে চায় নেমে পড়বে কিনা। যুবকটি একাকিত্বের নির্মম কোলাহলে। তাকায় বাইরে পশ্চিম আকাশে। আর ঠিক তখুনি ঘটে যায় তার বাইশ বয়সী জীবনের সবচেয়ে অভিনব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি।
নির্মেঘ আকাশের সুনীল সাগরে ভাসছে এক স্বপ্নের গালিচা। নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের এক বিস্ময়-নমুনা!নিঃসীম নান্দনিকতার সুনিবিড় অবয়ব-ভাসছে ঝলসানো সবুজ-ধূসর পত্রপল্লবে। উঁচুতে, অনেক উঁচুতে আশ্চর্য সুন্দরের আকাশী শরীর। দীঘল শাদা কাণ্ডের ওপর অপরূপ চিত্রপটে মোহময় ভঙিমায় দাঁড়িয়ে আছে বিমুগ্ধ আয়েশে ঢলে পড়া এক শ্যামলিম পৃথিবী, উদ্ভাসিত স্বপ্নের ধূসর জগৎ কুন্তলা, নীল আকাশে অর্ধমেলা বাহুর বৃক্ষ-য়্যুকেলিপ্টাস। ভালবাসার নান্দনিক শরীর। বিস্ময়-বিমুগ্ধ যুবকটি ভুলে যায় তার দাযিত্বশীল অস্তিত্ব। বিষন্ন খরতাপ দুপুর ম্লান হয়ে যায়, পিচঢালা পথে নিহত মেয়েটির রক্তের দাগ শুকিয়ে যায়, হারিয়ে যায় বন্দি কমরেডের মুখ, মিডনাইট অপারেশন আর বেচারী শান্তা সবই। বেঁচে থাকে শুধু ভরা যৌবনা এক উদ্দাম শরীর-অন্তহীন সৌন্দর্যের আধেয়া আকাশ-নীলিমায় উদ্বাহু য়্যুকেলিপ্টাস বৃক্ষটি।
এভাবেই একদিন যুবকটিকে দেখা গেল বাড়ির খোলা আঙ্গিনাগুলোতে চষে ঘুরে বেড়াতে, আপনমনে কিছু খুঁজতে। বাড়ির লোকজন অবাক হয়ে দেখে। এ-যে অভিনব। সারাটি দিনভর দরজা বন্ধ করে ঘুমে কাটানো রাতজাগা ছেলেটির আচরণে অবাক হয় সবাই। বলে না কেউ কিছু, সাহসে কুলোয় না। অস্বাভাবিক মেজাজী স্বল্পবাক ছেলে যে! শুধুই মন্তব্যহীন জিজ্ঞাসু মুখ চাওয়া-চাওয়ি। বিস্ময়ের ঘোর লাগল চোখে সেদিন, যেদিন সবাই প্রত্যক্ষ করলো তাদের বোহেমিয়ান সদস্যটি কতকগুলো সমজাতের বৃক্ষের চারা নিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হল। কেউ কেউ আড়ালে মুচকি হাসলো। তবে খুশিই মনে হল তাদের। ভাবখানা এমন ভাল, তবুও ভাল, অনেক ভাল।
যুবকটি দা-কোদাল খুঁজলো, শ্রমিক মিসির আলীকে ডেকে আনলো। বিরামহীন কাজে মেতে রইল সারাদিনমান। দেখতে দেখতে অযত্নে জাগা জঙ্গল আর আগাছা সব পরিষ্কার হয়ে গেল। পুরোনো বৃক্ষগুলোর ডালপালা কেটেছেটে প্রচুর জ্বালানীকাঠ মজুদ হল। গিন্নীরা দারুণ খুশি। আজন্ম উদাস বাড়িবিমুখ ছেলেটির এমন বাড়িমুখীনতা সবাইকে বড়ই প্রীত করলো। য়্যুকেলিপ্টাস-প্রীতি ছেলেটার সার্বিক বৃক্ষ-প্রীতিতে পরিণত হয়ে গেল। দেখতে দেখতে বাড়ির খোলা জায়গাগুলো য়্যুকেলিপ্টাস, মেহগনি,সেগুন, চাম, চাম্বুল, মেনজিয়াম, একাশী, দেবদারু ইত্যাদি নানা জাতের চারাগাছে ভরে গেল। প্রতিদিন চারাগুলোর গোড়ায় পানি ঢালতে ঘরের কাজের মেয়েদের ব্যস্ততা বেড়ে গেল। শান্তা আসে, দ্যাখে, আর মিটি মিটি হাসে।ভাবে, ভালো! বেশ ভালো! ভীষণ ভালো!

কপোতাক্ষ নদীতে কতই না কাণ্ড ঘটেছে। গড়িয়েছে কত স্রোত গড়াইয়ে। আর রূপসায় রূপালি ইলিশ সাঁতারও কেটেছে কত না রাত্রিদিন। পশুর নদীর কালোজলে ধরা পড়েছে ধবল পাঙ্গাস-কালোজলে ভীষণ মোটাসোটা। আর ভেসে গেছে চিংড়ির ঘের জোয়ার আর জলোচ্ছ্বাসে। ভেস্তে গেছে কোটি টাকার প্রজেক্ট। তবুও এগিয়েছে স্বদেশ কারো কৃতিত্ব ছাড়াই এক অমোঘ স্বনিয়মে। চেগুয়েভেরার মৃত্যুদিবস ঠিকই স্মরণ করেছে বিপ্লবীরা এদেশে। কিন্তু এগোয়নি বামপন্থী আন্দোলনগুলো কোন ঈপ্সিত পথে। তবে অগ্রগতি হয়েছে গোপন সংগঠনগুলোর আন্তঃদলীয় কোন্দল, রক্তপাত আর লুন্ঠনে। আর এভাবেই যুবকটি তিনটি বসন্ত পার করে দিল। প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধে সে-ও উন্মাতাল হিস্যা নিয়েছে। খতম করেছে কথিত প্রতিবিপ্লবী আর শ্রেণিশত্রুদের, লুন্ঠন করেছে থানা আর ব্যাংক। এতকিছুর পরও সাম্য প্রতিষ্ঠার কোন লক্ষণ দেখা গেল না বরং বেড়েই চললো সাম্যের নামে অস্বাভাবিক-অদ্ভূত সাম্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। তবুও প্রকল্পিত সাম্যবাদের মোহ সে ত্যাগ করতে পারেনি, পারেনি সন্ত্রাসের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে।
একদিকে ধ্বংসের তাণ্ডব, আর অন্যদিকে সৃষ্টির নেশা-বৃক্ষরোপণ। এ-যেন একক সত্তার খণ্ডিত অবয়ব।মেহগনির পাতা চিক চিক করে ঝলসে ওঠে ঝুপড়ি মাথা সবুজে। সেগুনের হলুদ দাগ-পড়া সবুজ পাতাগুলো ছাতার আকারে ধেই ধেই করে ওঠে যায় আকাশে, দোলে বাতাসে কম্পমান লাঠির শরীর। আর চাম্বুলের চিকন মিহি পত্রপল্লব চিক চিক করে জ্বলে গাঢ় সবুজের আগুনে স্বর্ণাভ সূর্যালোক-পোড়া। উইপিং দেবদারুর কিশোরী শরীরে সবুজ শাড়ির সতেরটি প্যাঁচ-বিনম্র দীঘল বধুটির মত শরমিন্দা দাঁড়িয়ে থাকে এটেসেঁটে। আর য়্যুকেলিপ্টাস আহা! ধবধবে মসৃণ উরুর ওপর আয়েশে দাঁড়ায় আকাশে হেলান দিয়ে।চোখ ধাঁধানো ধূসর-সবুজ পাতাগুলো আবেগে ঝুলে লটকে থাকে। একটি নয়, একসাথে শত শত শান্তা যেন ঝুলে থাকে। যুবকটি অপলক তাকিয়ে থাকে মায়াবী বৃক্ষের শরীরে। ভাবে, আরো উঁচুতে আকাশে সুঠাম শরীরী উদ্ভাসে মেতে উঠুক সুপ্রিয় বৃক্ষের আলুথালু শরীর, মেতে উঠুক মহা উৎসবে নিসর্গে নান্দনিক।
বাড়ির সীমান্তে চার কোণায় আরো চারটি য়্যুকেলিপ্টাস লাগাতে ইচ্ছে করে যুবকটার। মোটরবাইকটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ঢুকে পড়ে নার্সারিতে। খোঁজে নতুন চারা।পায় না। জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, সম্প্রতি এ বৃক্ষের চারা উৎপাদন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।কারণ? একটি প্রাপ্ত-বয়স্ক বৃক্ষ নাকি প্রতিদিন এক মণ পানি শোষণ করে। ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাবে এ আশঙ্কায়------আর শুনা হয় না যুবকটির, জ্বলে ওঠে-শোষক! বুর্জোয়া বৃক্ষ! সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে তার। মাথা থেকে পা পর্যন্ত রক্তের স্রোত দ্রুত ঘুরপাক খায়। সাঁ করে মোটরবাইকটি চালিয়ে চলে আসে বাড়িতে। শোবার ঘরে খাটের তলা থেকে হেঁচকা টানে বের করে আনে টিনের ট্রাংকটি। ডালা খোলে। চক চক করে জেগে ওঠে চাইনিজ কুড়ালটি-শোষকের শোণিতে শাণিত কৃপাণ। দুমদুম করে বেরিয়ে যায় কুড়াল হাতে। লক্ষ্য একটাই-শোষক বৃক্ষ নিধন!
তিনটি বছরে সযত্নে বেড়ে ওঠা সবচেয়ে বড় য়্যুকেলিপ্টাস গাছটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। উদ্ধত কৃপাণ মারমুখী। বিড়বিড় করে চেঁচায় যুবকটি-প্রলেতারিয়েতের প্রতিনিধি আমি, আর তুই বুর্জোয়া বৃক্ষ আমারই আঙ্গিনায়! আমারই সযত্নছায়ায় বেড়ে উঠবি! বাহ্ কী চমৎকার! আজ সবক'টাকে উচ্ছেদ করব। তেড়ে এগিয়ে যায়-আবার প্রস্তুতির জন্য কিছুটা পেছন ফেরে। ফের এগোতে যাবে-অমনি কি যেন হয়ে যায়, গাছটির দিকে তাকায় আড়চোখে। ধরা খেয়ে যায় যেন-কীভাবে আঘাত করবে সে! তিলে তিলে গড়ে তোলা ভালবাসার নন্দিত গতরে। এক-তালাক প্রাপ্তা বউটির মত ভীতু দৃষ্টিতে বৃক্ষটি অসহায় তাকিয়ে দেখে যেন দয়িতের আগুনঝরা মুখ। খানিকটা অপরাধবোধ জেগে ওঠে যুবকটার মনে। তার অন্তর্গত মানুষটি প্রতিবাদী হয়ে উঠতে চায়। ব্যরিকেড দেবে নাকি?
হাতের টান টান পেশী শিথিল হয়ে আসে। কি যেন ভাবে সে। খুবই সংক্ষিপ্ত সে ভাবনা। জেগে ওঠে আবার রোষে। না,আবেগের পথ বিপ্লবীর নয়-আপন মনেই উচ্চারণ করে যুবকটা। বুর্জোয়ার সাথে আপোষকামীতা বিপ্লবীর কাম্য হতে পারে না। কিন্তু কি এক অন্তর্গত আপোষকামীতা নিজের অজান্তেই তাকে যেন দুর্বল বরে দিচ্ছে। চাইনিজ কুড়ালটির শক্ত হাতলটা ইতোমধ্যে তার ডান কাঁধের ওপর এলিয়ে পড়েছে। কুড়ালের ধারাল অগ্রভাগটি যেন লজ্জায় মাথা হেট করে মাটির দিকে চেয়ে আছে। তার ভেতরের মানুষটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় তার মগজে। বৃক্ষটি কি সত্যিই অপরাধী? শোষক? বুর্জোয়ার প্রতীক? শোষিত শ্রেণির স্বার্থের শত্রু! নাকি এক অর্থহীন উন্মাদনা তাকে অন্ধ-উন্মাতাল করেছে? জীবনে এ-ই প্রথমবার একটি নির্বাক বৃক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আত্মসমীক্ষার সূচনা করে সে।
বৃক্ষটি তো তার জন্মের জন্য দায়ী নয়। নিসর্গের সন্তান হিসেবে এর চাহিদাও তো নৈসর্গিক। অস্তিত্বের স্বাভাবিক বিকাশের প্রয়োজনীয় রসদ তো মৃত্তিকার নাভিমূল থেকে সংগ্রহ করবেই। এ-তো তার জন্মগত অধিকার। প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকার। তবে ক্যানো সে শোষক হবে? তুলনামূলকভাবে কিছু বেশি পানি গ্রহণের মাধ্যমে উর্ধ্বাকাশে কিছুটা বেশি উড্ডয়ন কি তার সৃষ্টিজনিত যোগ্যতার প্রমাণ নয়? যোগ্যতমের বিকাশ কি স্বীকার্য নয়? ডারউইন বেটা তবে কি বলেছিল! আর যোগ্যতার সাথে কি প্রাপ্তির কোন-ও সংযোগ নেই?যোগ্যতা, মেধা, প্রজ্ঞা কি অপরাধ? তবে কেন বল প্রয়োগে সব কিছুকে সমান করে দেবার অর্থহীন আন্দোলন! সাম্য প্রতিষ্ঠার অস্বাভাবিক প্রচেষ্টা! চমকে ওঠে যুবকটি! এ-তো প্রচেষ্টা নয়, রীতিমত অপচেষ্টা!আত্মসমীক্ষার এক অভিনব আলোকোজ্জ্বল বাঁকে আবির্ভূত হয় যুবকটি। থিসিস আর এন্টিথিসিসের দ্বান্দ্বিক পথে উপনীত হয় সিনথেসিসে। মার্ক্স-এঙ্গেলস গৌণ হয়ে যায়। প্রত্যাবর্তন করে হেগেলে। শুভকামী চিন্তায়-মননে। ভাবে, মানুষের মৌলিক মানবীয় চাহিদার পূরণকে অস্বীকার কেন করবে? আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সাথে আত্মবিকাশের সর্বোত্তম সুযোগ তো সবাইকে দিতেই হবে।পাশাপাশি, অস্বাভাবিক-অবৈধ পুঁজি বিনিয়োগ ও বিকাশের সকল পথ বন্ধ করে দিলেই তো প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব।আর এজন্যে, প্রয়োজন জবাবদিহির চরম দাযিত্বশীল চেতনা। হেগেলের "চিন্ময় পরমসত্তা"কে মনে পড়ে তার।একাত্ম হয় বিশ্বাত্মার সাথে। নির্দেশ করে মহান দার্শনিক হেগেলকে-"কবর থেকে ওঠে এসো হে দার্শনিক, হেঁয়ালী রাখো, স্পষ্ট করে ব্যক্ত কর তোমার পরমসত্তাকে।"মনে পড়ে বিশ্বনবী (সা:)কে-পরকালীন জীবন, বিচার-ব্যবস্থা, পুরস্কার ও শাস্তি-অন্তহীন মহাজীবন। হঠাৎ করেই মৃদু বাতাস সচকিত করে তাকে। ওপরে তাকায়-দেখে য়্যুকেলিপ্টাসের পাতাগুলো খাড়া হয়ে যেন এতক্ষণ তার কথা শুনছিল।আর সে তাকাতেই শান্তার মত সম্মতিতে নুয়ে পড়লো।

দারুণ অনুশোচনা, অস্বস্তি আর আক্ষেপে ভরে ওঠে যুবকটির মন। চোখের সামনে সিনেমার মত ভেসে ওঠে প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারি সড়কে মাইকিং করে চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে ফেলা জামান সাহেবের শরীরটাকে। কী দোষ ছিল লোকটার?একজন স্বনামধন্য শিল্পপতি ছাড়া আর কী! বুঝে উঠতে পারে না সে শ্রেণিহীন সমাজের বাসনায় এ কোন শ্রেণিস্বার্থের সংগ্রাম! কেন মাথা কেটে মাতামুহুরি কিংবা মাথাভাঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া, গাছে লটকিয়ে দেয়া, কেন ব্যাংক লুট, থানা লুট, জিম্মি গ্রামবাসী! তার দুটি চোখ গলে লাভা হয়ে যায়। আলোকিত হতে থাকে তার সমগ্র সত্তাটি। কুড়ালটি ফেলে দেয় দূরে, এগিয়ে যায় মিনতি ভরে। জড়িয়ে ধরে বৃক্ষটির শরীর—"য়্যুকেলিপ্টাস! আমার ভালবাসা, আমার দর্শন! আই লাভ ইউ! আই লাভ------"আমি কি তবে শেষ পর্যন্ত বাদই পড়ে গেলাম"! দীর্ঘ প্রতীক্ষারতা শান্তার সকৌতুক প্রশ্নে ফিরে তাকায় যুবকটি। হাসে। মিটিমিটি। বড়ই পবিত্র সে হাসি। উড়িয়ে দেয় আকাশে প্রেমময় দুটি হাত, বলে-"এসো"। আর তখনই আকাশ-বাতাস-বৃক্ষ কাঁপিয়ে বেজে ওঠে তীব্র হুইসেল। পুলিশ চারদিক ঘিরে ফেলে। ধরা পড়ে যায় নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থী দলের যুবকটি। শান্তা নামের মেয়েটি নির্বাক এগিয়ে যায়, জড়িয়ে ধরে য়্যুকেলিপ্টাস বৃক্ষটিকে। এক সাগর অশ্রু ঢেলে দেয় শোষক বৃক্ষটাকে। আর মিশে থাকে এক অখণ্ডকাল বৃক্ষের শরীরে। নারী বৃক্ষ হয়ে যায় আর বৃক্ষ রমণী।(শেষ)

কবি,লেখক ও গল্পকার:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ