পিত্ত থলির পাথর : লক্ষণ ও করণীয় : পিত্তথলির পাথর গলানোর আধুনিক চিকিৎসা


পিত্ত থলির পাথর : লক্ষণ ও করণীয়

পিত্তথলিতে পাথর রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।কিন্তু পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে এমনটি প্রথমে অনেকে বুঝতে পারে না। এমনকি লক্ষণ প্রকাশ পায় না। নীরবেই দেহে এর প্রতিক্রিয়ায় নানা রোগ ডেকে আনতে পারে। সুতরাং দেহের সুস্থতা বজায় রাখার জন্য সচেতন ও সতর্কতা প্রয়োজন। রোগ সৃষ্টির শুরুতেই অবশ্যই চিকিৎসা করা অতি প্রয়োজন। আপনার অবহেলা বা অযত্নে মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে রোগটি।
পিত্ত থলিতে পাথর হওয়ার কারণঃ
ক) পিত্ত রসে উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টেরল থাকলে
খ) পিত্ত রসে অধিক পরিমাণে বিলিরুবিন থাকলে
গ) পিত্ত থলি যথেষ্ট পরিমাণ পিত্ত নিঃসরণ করে খালি না হলে।

পিত্তথলিতে পাথরের লক্ষণ
-ওপরের পেটের ডান দিকে তীব্র ব্যথা ডান কাঁধে ছড়ায় এবং রোগীর বমি হয়।
-তৈলাক্ত খাবার, চর্বিজাতীয় খাবার বা মাংস খেলে এ রকম ব্যথা হতে পারে। তবে গ্যাসের ওষুধ খেলে এটি ভালো হয়ে যায়।
 -মধ্য পেটে ব্যথা হয়। মধ্য পেটে ব্যথা হয়ে একেবারে পেছন দিকে চলে যায়।
- অনেক সময় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে। এ লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
-জ্বরের সঙ্গে বমি হতে পারে। রোগী এক্ষেত্রে টক্সিক হয়ে যেতে পারে।
 -জ্বরের সঙ্গে জন্ডিস হতে পারে। এ ক্ষেত্রে যা হয় তা হলো পাথর হয়তো পিত্তনালিতে চলে গেছে। সে জন্য জ্বর হয়ে কোলেনজাইটিস নিয়ে আসতে পারে।

এগুলোর মধ্যে কোনো একটি লক্ষণ থাকলেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। একেবারেই অবহেলা করবেন না বা ফেলে রাখবেন না। অল্প সমস্যাতে গ্যাসের ওষুধ খাওয়া কোনো স্থায়ী সমাধান নয়।

পিত্ত থলির পাথর প্রতিরোধে করণীয়ঃ

★দৈনন্দিন খাবার গ্রহণে অনিয়ম করা যাবে না।
★দেহের ওজনাধিক্য নিরসনে তা ধীরে ধীরে কমাতে হবে কেননা দ্রুত ওজন কমালে পিত্ত থলিতে পাথর জমতে পারে। তাই দেহের অতিরিক্ত ওজন কমাতে গেলে প্রতি সপ্তাহে অন্তত ০.৫ থেকে ১ কেজি ওজন কমানোই বাঞ্ছনীয়। 
★প্রচুর পরিমানে আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে --
সবুজ শাক সবজি, তাজা ফল ও শস্য দানা।
★সর্বদা স্বাস্থ্যকর দৈহিক ওজন বজায় রাখা। 

পিত্তথলির পাথরের আধুনিক চিকিৎসাঃ

কিছু ওষুধ রয়েছে যা দিয়ে পিত্তথলির  পাথর গলানো সম্ভব।  পিত্তথলির পাথর সাধারণত তিন প্রকারের...
১. কোলেস্টেরল স্টোন
২. পিগমেন্ট স্টোন
৩. মিক্সড স্টোন

এর মাঝে কোলেস্টেরল স্টোন ওষুধের মাধ্যমে গলিয়ে ফেলা সম্ভব।  এতে আলট্রাসনোগ্রাফির ভূমিকা ব্যাপক, কেননা একটি ভালো উন্নত রেজুলেশনের মেশিনের সাহায্যে একজন উচ্চতর ডিগ্রিধারী দক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক নির্ভুলভাবে পিত্তথলির পাথরের প্রকৃতি নির্ণয় করতে পারেন।
এক্ষেত্রে দেখা গেছে পাথর সাধারণত একটি হয় এবং ভাসমান হয়।

মানব সভ্যতার ক্রমাগত উন্নয়নের সাথে সাথে আমাদের লাইফ স্টাইল এবং খাদ্যাভ্যাসেরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে...  ফলশ্রুতিতে আমরা আয়েশি জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, হাইলি প্রসেসড খাবার ও ফাস্ট ফুডের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি।  এতে আমদের দেহের স্থুলতা দেখা দিচ্ছে, ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে, ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বির আধিক্য, উচ্চ রক্তচাপ, ফ্যাটি লিভার, পিত্তথলিতে পাথর ইত্যাদি সমস্যা মহামারি আকারে আবির্ভূত হচ্ছে। ফাস্ট ফুডের আসক্তির ফলে  আজকাল শিশু কিশোর তরুণদের মাঝেও পিত্তথলির পাথরের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে।

আরসোডিঅক্সিকোলিক এসিড নামে যে ওষুধটি পিত্তথলির পাথর গলানোতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে সেটা তিন উপায়ে কাজ করে...
১. কোলেস্টেরল এর নিঃসরণ কমায়
২. কোলেস্টেরল এর শোষণ কমায়
৩. কোলেস্টেরল এর গলানো বৃদ্ধি করে
সর্বোপরি কোলেস্টেরল স্টোন এর জমাট বাঁধতে নিরুৎসাহিত করে।

ভাল ফলাফল পেতে রোগীকে অবশ্যই সমঝদার হতে হবে এবং কমপক্ষে দুই বছরের জন্য ওষুধটি সেবন করতে হবে।
আলট্রাসনোগ্রফিতে দেখে নিতে হবে সিস্টিক ডাক্টটি কার্যক্ষম এবং  পিত্তথলিটি ফাংশনিং রয়েছে। পাথরটি রেডিওলুসেন্ট ও ভাসমান রয়েছে। পাথর যেন ১৫ মিমি. এর কম আকৃতির হয় এবং সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায় যদি পাথরের আকৃতি ৫ মিমি. এর কম থাকে।
আর যেসব পাথরের ক্যালসিয়াম উপাদান কম থাকে সেই পাথরগুলোই দ্রুততম সময়ে গলে যায়। বিপত্তি হলো আলট্রাসাউন্ড বা সিটি স্ক্যান মেশিনের সাহায্যে এই ধরনের পাথরকে সুচারুরূপে সংজ্ঞায়িত করা।

এ ধরণের চিকিৎসায় সফলতার হার...
পাথরের আকৃতি যদি < ৫ মিমি. হয় তাহলে প্রায় শতভাগ গলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে,
আর পাথরের আকৃতি যদি < ২০ মিমি. হয় সেক্ষেত্রে গলে যাওয়ার সম্ভাবনা ৪০ থেকে ৬০ ভাগ।

বড় আকৃতির ও অভাসমান পাথর গলতে আরও অধিকতর সময় লাগতে পারে কিংবা কখনোই আর নাও গলতে পারে।

এ ধরণের চিকিৎসায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে পাথরের জন্য যে পেটে ব্যথা তা কমে যায়।
পাথর জমে যাওয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে ২৫ থেকে ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রথম দুই বছরের মধ্যে কিন্তু তিন বছর পরে আর এরকমটি ঘটে না।
পাথর জমে যাওয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটে সাধারণত একাধিক কোলেস্টেরল পাথর থাকলে।

এই ধরণের চিকিৎসায় পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া তেমন নেই বললেই চলে।

গর্বের বিষয় হলো আমাদের দেশের অনেক ওষুধ শিল্প প্রতিষ্ঠান এধরণের উন্নত ও অত্যন্ত কার্যকরী ওষুধ তৈরি করে বাজারে নিয়ে এসেছে এবং বিদেশেও অত্যন্ত সুনামের সাথে রপ্তানি করছএম সাঈদুল হক

সহকারী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ 
চীফ কনসালট্যান্ট, ঢাকা গ্যাস্ট্রো-লিভার সেন্টার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ