‘মৌলি, তোমাকে বলি, তোমার মতোই আমি এক সময় ছিলাম-ছোট, ছিলাম গাঁয়ে, যেখানে মেঘ নামে সবুজ হয়ে নীল হয়ে লম্বা হয়ে বাঁকা হয়ে শাপলা ফোটে; আর রাতে চাঁদ ওঠে শাদা বেলুনের মতো। ওড়ে খেজুর গাছের ডালের অনেক ওপরে। যেখানে এপাশে পুকুর ওপাশে ঘরবাড়ি। একটু দূরে মাঠে ধান সবুজ ঘাস কুমড়োর হলদে ফুল। একটা খাল পুকুর থেকে বের হয়ে পুঁটিমাছের লাফ আর খলশের ঝাঁক নিয়ে চলে গেছে বিলের দিকে। তার উপর একটি কাঠের সাঁকো। নিচে সাঁকোর টলোমলো ছায়া। তার নাম গ্রাম। “ “তুমি জানো না, কোনোদিন জানবে না,কেমন লাগে একটি নড়োবড়ো বাঁশের পুলের ওপর দাঁড়িয়ে কালো জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে। তুমি শিশির দেখো নি, কুয়াশা দেখো নি, কচুরি ফুল দেখো নি। তুমি ধানের শীষ দেখেছো টেলিভিশনে, চিল দেখেছো ছবির বইতে। নালি বেয়ে ফোঁটাফোঁটা খেজুরের রস ঝরতে দেখো নি, পুকুরে দেখো নি মাছের লাফের দৃশ্য। তুমি জানো না কেমন লাগে উথাল-পাতাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে, আর কেমন লাগে একটি পাখির পেছনে ছুটে ছুটে সকালকে দুপুরের দিকে গড়িয়ে দিতে। আমি জানি; - না আমি জানতাম।এখন তো আমি জড়িয়ে আছি শহরে; আমার পায়ের নিচে শক্ত কংক্রিট,চোখে নিঅন আলো, চারদিকে গোঁ গোঁ করা ট্রাকের উল্লাস। কতো দিন আমি, তোমার মতোই চাঁদ দেখিনি। শহরে কি চাঁদ ওঠে? কুয়াশা নামতে দেখি নি দুধের সরের মতো, পদ্মার পারে দেখি নি ধবধবে কাশফুলের সাদা মেঘ। কতো দিন দেখি নি ধানের গুচ্ছ, তারার গুচ্ছের মতো। কিন্তু যখন আমি হাঁটি, বিকেলে বেড়াই, বই পড়ি, ঘুমোতে যাই, গড়াই স্বপ্নের কথা ভেবে ভেবে, তখন আমি একটি ফুলের গন্ধ পাই। সে-ফুল আমার গ্রাম, সে-ফুল আমার গাঁ।আমার ছোটোবেলার গ্রাম। রাড়িখাল।“ “গ্রাম মরে যাচ্ছে। গ্রামেরা মরে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে রাড়িখাল। ছিলো একটি মিষ্টি মেয়ের মতো-খুব রূপসী-চাঁদের মতো। কোন মড়কে ধরলো তাকে! তার চোখ বসে যাচ্ছে, কালচে দাগ চোখের চারপাশে। সে গোলগাল মুখটি নেই, কেমন শুকনো। এখনি ঢলে পড়ে যাবে যেনো। গ্রাম মরে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে রাড়িখাল। তার বুকের ভেতর কোন অসুখ বাঁধলো বাসা? খুঁটেখুঁটে কুরেকুরে খাচ্ছে তাকে কোন অসুখ? সে কি একেবারে মরে যাবে? ঢুকবে কবরে? তাকে ঘিরে রাতভর চিৎকার করবে কয়েকটা লালচে শেয়াল?”

0 মন্তব্যসমূহ