বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে প্রতিবছর সারাবিশ্বে প্রায় ৬০ লাখ লোক ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাবে মারা যায় (সর্বমোট মৃত্যুর প্রায় ১০%) যার প্রায় ৬ লাখ পরোক্ষ ধূমপানের স্বীকার।১৯৫০ সালে Richard Doll নামক বিজ্ঞানী ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে একটি গবেষণা প্রকাশ করেন যেখানে তিনি ধূমপান ও ফুসফুস ক্যান্সারের একটি সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (CDC) সেন্টার ধূমপানকে সারাবিশ্বব্যাপী অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
আজ স্বাস্থ্যের উপর ধূমপানের মারাত্বক ক্ষতিকারক প্রভাব ও ধূমপান ছাড়ার সহজ উপায় নিয়ে আলোচনা করবো।
ধূমপান আমাদের স্বাস্থ্যের কী কী ক্ষতি করে
অথবা ধূমপানের ফলে যেসব ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে
অথবা ধূমপানের ক্ষতিকারক প্রভাব
আরও পড়ুন: ব্রণের কারণ ও ব্রণ থেকে মুক্তির উপায়
-ধূমপানের কারণে ডায়াবিটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। টোবাকো ব্লাড সুগারের মাত্রা বৃ্দ্ধি করে। ডায়াবিটিসে আক্রান্ত রোগীরা ধূমপান করলে তাঁদের মধ্যে হৃদরোগ, কিডনির সমস্যা, নার্ভের সমস্যা, অন্ধত্বের সমস্যা প্রভৃতি দেখা দিতে পারে।
-ক্যানসারের অন্যতম কারণ হল ধূমপান। তবে সমস্ত ক্যানসারের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারই সবথেকে বেশি হয় ধূমপান করলে।
-হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ব্লাড ভেসেল ডিজিজ প্রভৃতি কার্ডিওভ্যাসকুলার ডিজিজের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় ধূমপান।
-ধূমপানের কারণে বাড়তে পারে স্ট্রেচ মার্ক। নিকোটিন ত্বকের কানেক্টিভ টিস্যু ও ফাইভারের ক্ষতি করে দেয়। ফলে সাদা স্ট্রেচ মার্ক দেখা দিতে পারে।
-ধূমপানের কারণে আপনার চোখে কম বয়সেই ছানি পড়তে পারে। নিয়মিত ধূমপান চোখে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়ায়। ধূমপান ছাড়ার পরও অবশ্য চোখে ছানি পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
-হেয়ার ফলিকলে প্রচ্ছন্ন প্রভাব বিস্তার করে ধূমপান। যার জেরে চুলের গোড়ার ক্ষতি হয়। ধূমপানের প্রভাবে চুল পড়তে শুরু হয়। কারণ ফলিকল কমজোর হয়ে গেলে চুল সহজেই ভেঙে যায়। ধূমপান করা মানুষের টাক পড়ার সম্ভাবনা তাই বেশি।
-গর্ভবতী মহিলাদের ধূমপান করা একেবারেই উচিত্ নয়। গর্ভবতী মহিলারা ধূমপান করলে খুব ছোট বয়স থেকেই কিডনির সমস্যা হতে পারে শিশুর।
-সিগারেট, বিড়ি, হুকো ইত্যাদিতে থাকা তামাক থেকে উৎপন্ন নিকোটিন রক্ত চলাচলে বাধা দেয়। অনেক সময় অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে।
-ধূমপানের জন্য শরীরে ভিটামিন সি-এর অভাব দেখা দিতে পারে। ত্বককে উজ্জ্বল ও সুরক্ষিত রাখার জন্য ভিটামিন সি একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। ধূমপান ত্বকে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে। ফলে ত্বক অনুজ্জ্বল ও ফ্যাকাশে দেখাতে পারে।
-ধূমপানের ফলে চেহারা বুড়িয়ে যেতে পারে তাড়াতাড়ি। অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে আপনাকে বয়সের তুলনায় বেশি বয়স্ক দেখা দিতে পারে। কারণ ধূমপান বলিরেখা তৈরির ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন প্রভাব রাখে।
-ধূমপানের ফলে ক্ষুধা কমে যেতে পারে। ফলে চেহারায় তার ছাপ পড়তে পারে প্রকটভাবে।
ধূমপান ছাড়ার সহজ উপায়
আরও পড়ুন: ব্রা না পরার যত উপকারিতা
√ ধূমপান ত্যাগের জন্য স্বচ্ছ পরিকল্পনা থাকা চাই। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে একটি নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করুন। মনে রাখবেন, এই তারিখ কোনোভাবেই আর পেছানো যাবে না। তারিখ বাছাইয়ের সময় এমনভাবে নিজেকে বোঝাবেন, যেন এটিই ধূমপান ত্যাগের জন্য শেষ তারিখ। ওই তারিখের পর ধূমপায়ী বন্ধুদের কোনো পার্টি থাকলেও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন।
√ কেন ধূমপান ছাড়বেন, সেই তালিকা তৈরি করুন। অসংখ্য কারণ পাবেন ধূমপান ছাড়ার। চিন্তা করে নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে একটি শক্ত তালিকা তৈরি করুন। তালিকায় আপনার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে আপনার আশপাশের মানুষের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর ধূমপানের প্রভাব, আর্থিক অপচয় ইত্যাদি থাকা আবশ্যক। এরপর যখন ধূমপানের ইচ্ছা জাগবে, তখনই এসব কারণ ভাবতে শুরু করবেন। এতে আপনার ধূমপানের প্রতি আগ্রহ কমতে থাকবে।
√ হয়তো এর আগেও আপনি ধূমপান ছাড়ার পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এবারের পরিকল্পনাও যে সেগুলোর মতো সফলতার মুখ দেখবে না, এমন ভাবা যাবে না। বরং আপনার এবারের প্রচেষ্টা সফল হবেই—এমন আত্মবিশ্বাস রাখুন। আগেরবারের ভুলগুলোর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেদিকে সাবধান থাকতে হবে।
√ গবেষকেরা বলছেন, অ্যাকোহলমিশ্রিত পানীয়, কোমলপানীয়, চা, কফি ইত্যাদি পানের সময় অনেকে মনে করেন যোগ্য সংগত সিগারেট। যা পানীয়র স্বাদ আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই এ ধরনের পানীয়র অভ্যাস প্রচুর ছেড়ে ফলের রস আর পানি পান করুন। এখন বাজার নানা রকম রসাল ফলে ভরপুর। সেসব ফলের জুস করে খেতে পারেন।
√ আমেরিকান একটি গবেষণা বলছে, অনেকের কাছে মাংসজাতীয় খাবার খাওয়ার পর ধূমপান উপভোগ্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ফল কিংবা সবজিজাতীয় খাবারের পর ধূমপান কিছুটা স্বাদ হারায়। তাই ধূমপান ছেড়ে দিতে চাইলে কিছুদিন মাংস এড়িয়ে খাবারের তালিকায় শাকসবজি ও ফলমূল রেখে দেখতে পারেন। আর খাওয়া শেষ করেই এমন স্থান বা কক্ষে চলে যান, যেখানে ধূমপানের সুযোগ নেই।
√ ধূমপান ত্যাগের ক্ষেত্রে আপনার আশপাশের মানুষের ভূমিকা অপরিসীম। তাই যতটা সম্ভব ধূমপায়ী বন্ধুদের আড্ডা এড়িয়ে চলুন। অন্তত ধূমপান ছাড়ার পর প্রথম কয়েক দিন ধূমপায়ী বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি আড্ডা থেকে বিরত থাকুন। একই সঙ্গে অধূমপায়ী বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর চেষ্টা করুন।
√ ব্যস্ততা বাড়ান: দিনের কোন সময়গুলোতে আপনার ধূমপানের ইচ্ছা বেশি জাগে, সেটি শনাক্ত করুন। এরপর ওই সময়গুলোতে নিজেকে কোনো কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখুন। কোনো কাজ খুঁজে না পেলে হাঁটাহাঁটি করুন। ব্যায়াম করে বা পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আড্ডা দিয়েও নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারেন। ব্যস্ততা বাড়লে ধূমপানের কথা ভুলে থাকা সহজ হবে।
√ মুখ খালি রাখবেন না: মুখ খালি থাকলেই ধূমপানের আগ্রহ জাগবে। তাই ধূমপান বাদ দিতে চাইলে মুখ খালি রাখা যাবে না। এ সময় মুখে চকলেট, লজেন্স বা চুইংগাম রাখুন। পকেট থেকে সিগারেট, ম্যাচের বাক্স ফেলে দিয়ে লজেন্স কিংবা চুইংগাম রাখুন।
আরও পড়ুন:
√ ধূমপান ছেড়েছেন, এমন কাউকে চেনা থাকলে তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিন। তাঁর অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগান। ফেসবুকে একাধিক গ্রুপ রয়েছে, যেখানে ধূমপান ছাড়ার ব্যাপারে পরামর্শ ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হয়। এসব গ্রুপে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে।
√ কোনো কিছুতেই আসক্তি কমাতে না পারলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া নিয়ে সংকোচ বা হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো কারণ নেই। বরং আপনার এই পদক্ষেপের মাধ্যমেই আপনি নিজেকে ধূমপানের আসক্তি থেকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসতে পারবেন।
আরও পড়ুন:

0 মন্তব্যসমূহ