মদিনা সনদ :বিশ্ব ইতিহাসে মদিনা সনদের গুরুত্ব

মদিনা সনদ

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবুয়তপ্রাপ্তির পর মানবজাতির মধ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম হচ্ছে মদিনা সনদ বা সংবিধান প্রণয়ন। মদিনা সনদ হচ্ছে পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় সংবিধান।        

৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন মদিনায় হিজরত করেন তখন মদিনার সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়।মহানবী (সাঃ) তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দ্বারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে মদিনা ও এর আশপাশে বসবাসকারী মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান ও পৌত্তলিকদের মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি স্থাপন করতে না পারলে একটি সুসংহত রাষ্ট্র স্থাপন করা সম্ভব নয়। তাই হিজরতের অব্যবহিত পরেই তিনি মদিনায় অবস্থানকারী মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন ও মদিনায় বিবদমান গোত্রগুলোর মধ্যকার বিরোধ মীমাংসা করে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের প্রয়াস পান। এ উদ্দেশ্যে তিনি মদিনায় বসবাসরত সব জাতির জন্য ৬২২ খ্রিস্টাব্দে একটি সনদ প্রণয়ন করেন, যা বিশ্ব ইতিহাসে মদিনা সনদের নামে পরিচিত। 

মদিনা সনদের ধারাগুলো হলো :
০১);এটি নবী মুহাম্মদ সা: থেকে জারি করা একটি দলিল, যার ভিত্তিতে মুমিন, কুরাইশ ও ইয়াসরিব (মদিনার) গোত্রভুক্ত মুসলমান এবং যারা তাদের অনুসারী কিংবা তাদের সাথে কর্মের বন্ধনে বা লেনদেনে আবদ্ধ, তাদের সবার পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত হবে। এরা সবাই মিলে এক জাতিগোষ্ঠী, একটি উন্মাহ হিসেবে বিবেচিত হবে

০২) কুরাইশ মুহাজিরেরা তাদের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রক্তপণ আদায় করতে থাকবে।

০৩) যেকোনো যুদ্ধে যুদ্ধবন্দীদেরকে দয়া ও ইনসাফের রীতিতে ব্যবহার করা হবে, যা মুমিনদের স্বভাবসুলভ (জাহেলি যুগের প্রচলিত সহিংসতা ও শ্রেণীভেদ বর্জনীয়)।

০৪) বনু আউফ (মদিনার একটি গোত্র) তাদের প্রচলিত নিয়ম অনু

যায়ী তাদের মধ্যকার রক্তপণ নির্ধারণ করবে ।

০৫) যেকোনো যুদ্ধে, যদিও তা মুসলমান ছাড়া অপর গোত্রগুলোর মধ্যে সংঘটিত হয়, সে ক্ষেত্রেও যুদ্ধবন্দীদের প্রতি দয়ার্দ্র ও ইনসাফের আচরণ করতে হবে, ইসলামপূর্ব রীতিতে নয়।

০৬) বনু সাইদা, বনু হারিস, বনু জুশাম ও বনু নাজ্জারও উপরোল্লিখিত মূলনীতি অনুযায়ী পরিচালিত হবে।

০৭) বনু আমর, বনু আউফ, বনু আন-নাবিত ও বনু আল-আউসও একটি মূলনীতি অনুসরণ করবে।

০৮) বিশ্বাসী মুসলমানেরা তাদের যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণের ব্যবস্থা করবে। এবং এ দায়িত্ব সামগ্রিকভাবে উম্মাহ বা জাতির সবার ওপর বর্তাবে, শুধু সংশ্লিষ্ট পরিবারের ওপর নয়।

০৯) কোনো মুমিন অপর মুমিনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার আজাদ করা দাসের সাথে মিত্রতা গড়ে তুলবে না।

১০) আল্লাহকে ভয় করে এমন সব মুমিন যেকোনো বিশ্বাসঘাতকদের প্রতিরোধ করবে। সেই সাথে যারাই জুলুম, বেইনসাফি, পাপাচার, দুর্নীতি কিংবা শত্রুতার ইন্ধনদাতা তাদেরকে প্রতিরোধ করবে।

১১) এ ধরনের কাজে জড়িত যে কেউ, এমনকি সে যদি নিজের পুত্র বা স্বজনদের মধ্যেও হয়, তাকেও ছাড় দেয়া হবে না।

১২) কোনো মুমিন অপর কোনো মুমিন ভাইকে হত্যা করবে না কোনো কাফেরের স্বার্থে (এমনকি সে কাফের যদি তার নিকটাত্মীয়ও হয়)।

১৩) কোনো বিশ্বাসী মুমিন কোনো কাফেরকে অপর বিশ্বাসী মুমিনের বিরুদ্ধে সহায়তা করবে না।

১৪) আল্লাহর নামে দেয়া সুরক্ষা সবার জন্যই মান্য ও প্রযোজ্য হবে। মুমিনদের মধ্যে দুর্বলতম কেউ যদি কাউকে সুরক্ষার প্রতিশ্র“তি দেয়, তা সব মুমিনের জন্য অবশ্য পালনীয় হবে।

১৫) গোত্র নির্বিশেষে সব বিশ্বাসী মুমিন পরস্পর বন্ধু হিসেবে বিবেচিত হবে।

১৬) যেসব ইহুদি মুমিনদের মিত্র হবে, তাদেরকে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে এবং তাদের সমানাধিকার স্বীকৃত হবে (রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার সাপেক্ষে এরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আইনগত সব অধিকার ভোগ করবে)।

১৭) কোনো ইহুদিকেই ইহুদি হওয়ার কারণে কোনো ধরনের বৈষম্যের শিকার করা হবে না।

১৮) ইহুদিদের শত্রুদের (এমনকি সে যদি বিশ্বাসীদের মিত্রও হয়) সহায়তা করা হবে না।

১৯) মদিনার অধিবাসীদের সাথে আংশিক শান্তিচুক্তি অগ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ মদিনার অধিবাসী সবাই একই শত্রুতা বা মিত্রতার অধীনে, আলাদা আলাদাভাবে নয়।

২০) মুমিনেরা যখন আল্লাহর পথে জিহাদে থাকবে, সে যুদ্ধাবস্থায় মদিনার কারো সাথে আলাদা মিত্রতা চুক্তি করা যাবে না।

২১) যুদ্ধ বা শান্তির সময়ের সব শর্তাবলি ও অবস্থাবলি মদিনার সবার ওপর সমভাবে প্রযোজ্য হবে।

২২) যেকোনো যুদ্ধযাত্রায় একজন ঘোড়সওয়ার সহযোদ্ধার সাথে তার বাহন ভাগাভাগি করবে।

২৩) একজন মুমিন আল্লাহর পথে লড়াই রত অপর বিশ্বাসী মুমিনের রক্তের প্রতিশোধ নেবে।

২৪) বিশ্বাসী মুমিনেরা ঈমানের বলে বলীয়ান ও কুফরের বিরুদ্ধে দৃঢ়পদ এবং ফলশ্র“তিতে আল্লাহর দেয়া হেদায়েতের সম্মানে ভূষিত। অপরাপর গোত্রগুলোর এ মর্যাদা অর্জনে অভিলাষী হওয়া উচিত।

২৫) কোনো কাফের মক্কার কুরাইশদের (যুদ্ধলব্ধ) শত্রুসম্পত্তি নিজ আওতায় রাখার অধিকারী নয়। যেকোনো শত্রুসম্পত্তি রাষ্ট্রের হেফাজতে রাখতে হবে।

২৬) কোনো কাফের বা অধিবাসী কুরাইশদের সপক্ষে সুপারিশ করবে না, কেননা কুরাইশরা মদিনা নিবাসীদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

২৭) যদি কোনো কাফের কোনো মুমিনকে যথাযথ কারণ ছাড়া হত্যা করে, তবে তাকেও হত্যা করা হবে, যতক্ষণ না তার স্বজনেরা সন্তুষ্ট হয়। সব মুমিন এ ধরনের খুনির বিপক্ষে থাকবে এবং হত্যাকারীকে কখনোই আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেবে না।

২৮) কোনো ব্যাপারে পারস্পরিক মতবিরোধের ক্ষেত্রে তা সমাধানের জন্য আল্লাহ ও তার রাসূল সা:-এর কাছে ন্যস্ত করা হবে।

২৯) ইহুদিরাও যেকোনো যুদ্ধে সহযোগিতায় মুমিনদের সাথে সমভাবে অবদান রাখবে।

৩০) বনু আউফ গোত্রের অধীন ইহুদিরা মুমিনদের সাথে একই সমাজের অধীন হিসেবে বিবেচিত হবে। তাদের মুক্ত করে দেয়া গোলামদের জন্যও একই বিধান প্রযোজ্য হবে। যারা অন্যায় ও পাপাচারে লিপ্ত তাদের এবং তাদের পরিবারবর্গের জন্য এ ঘোষণা প্রযোজ্য হবে না।

৩১) বনু নাজ্জার, বনু আল হারিস, বনু সাইদা, বনু জুশাম, বনু আউস সালাবা ও জাফনা এবং বনু শুতাইরা গোত্রের সব ইহুদির জন্য উপরোল্লিখিত ঘোষণা প্রযোজ্য হবে।
৩২) আস্থা ও আনুগত্যই বিশ্বাসঘাতকতার দুর্বলতার প্রতিষেধক।

৩৩) সালাবা গোত্রের মুক্ত করা দাস সালাবা গোত্রের সমান মর্যাদার অধিকারী হবে। এ সমানাধিকার প্রযোজ্য হবে ভারসাম্যপূর্ণ লেনদেন, যথার্থ নাগরিক দায়িত্ব পালন এবং যুদ্ধে অংশ নেয়ায়।

৩৪) যারা ইহুদিদের সাথে মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ, তাদের সাথে সে মতেই আচরণ করা হবে।

৩৫) এ চুক্তিনামার অংশীদার কেউ মুহাম্মদ সা:-এর অনুমতি ছাড়া যুদ্ধযাত্রা করতে পারবে না। যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবিধান করা হবে। ৩৬. যে কেউ কোনো ধরনের সতর্কবার্তা ছাড়া অন্যায়ভাবে অপরকে হত্যা করলে সে নিজেকে এমনকি নিজের পরিবারবর্গকে হত্যাযোগ্য করে তুলবে। ৩৭. মুসলমান ও ইহুদি উভয়ই তাদের নিজ নিজ যুদ্ধযাত্রার খরচ বহন করবে।

৩৮) বাইরের যেকোনো শত্রুর আক্রমণে উভয়ই একে অপরের নিরাপত্তা বিধানে এগিয়ে আসবে।


৪০) আস্থা ও আনুগত্যই বিশ্বাসঘাতকতার দুর্বলতার প্রতিষেধক। যারা পারস্পরিক পরামর্শকে অবজ্ঞা করে তারা মূলত আস্থা ও আনুগত্যের সঙ্কটে ভোগে।

৪১) কোনো ব্যক্তি তার মিত্রদের কাজের দায় বহন করবে না।

৪২) কারো প্রতি জুলুম করা হলে তাকে সহায়তা করা সবার অবশ্য কর্তব্য। ৪৩. ইহুদিরা কোনো যুদ্ধে অংশ না নিলেও সে যুদ্ধের খরচ বহন করতে সহায়তা করবে।

৪৪) চুক্তিবদ্ধ সবার জন্য ইয়াসরিব (মদিনা) হবে নিরাপত্তার শহর।

৪৫) কোনো অপরিচিত ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ যে গোত্রের মিত্রতায় আবদ্ধ, তাকে সে গোত্রের একজন হিসেবে বিবেচনা করে তার সাথে আচরণ করা হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে কোনো অন্যায় বা বিশ্বাসঘাতকতা না করেছে। রাষ্ট্রবিরোধী যেকোনো উসকানিমূলক কার্যকলাপ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

৪৬) কোনো নারীকে শুধু তার গোত্রের অনুমতিক্রমেই অপর কেউনিরাপত্তাধীন করতে পারবে।

৪৭) কোনো ধরনের মতবিরোধ কিংবা মতদ্বৈততার ক্ষেত্রে, যা পারস্পরিক বিবাদের কারণ হতে পারে; তা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সা:-এর কাছে সমাধানের জন্য ন্যস্ত করা হবে। তিনি এ দলিলের মধ্যকার যথার্থ কল্যাণকর অংশ অনুসরণ করবেন।

৪৮) কুরাইশ ও তাদের মিত্রদের সাথে কোনো ধরনের নিরাপত্তা চুক্তি নয়। 

৪৯) মদিনার ওপর যেকোনো আক্রমণ এই চুক্তিবদ্ধ সবাই সমভাবে প্রতিহত করবে।

৫০) যদি এ চুক্তির মুসলমান ছাড়া অপর পক্ষসমূহ কারো সাথে শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়, তবে তারা তা মেনে চলবে। যদি মুসলমানদেরকেও এ শান্তিচুক্তি মানতে আহ্বান জানানো হয়, তারা তা মেনে চলবে, শুধু এরা যখন আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত হয় সে সময় ছাড়া।

৫১)  ভালো কিংবা মন্দ প্রত্যেকেই তার নিজস্ব দল বা গোত্রের কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব বহন করবে। গোত্রীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় এর বিকল্প নেই।

৫২) আল আউস গোত্রের ইহুদি এবং তাদের মুক্ত করে দেয়া দাসেরা যত দিন এ চুক্তি মেনে চলবে, তত দিন পর্যন্ত সমানাধিকার ভোগ করবে।

৫৩) আস্থাই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিষেধক। যে কেউ আস্থার সাথে কাজ করবে, তা তার নিজের জন্যই কল্যাণকর হবে।

৫৪) আল্লাহ এ চুক্তিকে অনুমোদন দিয়েছেন।

৫৫) কোনো অপরাধী বা অন্যায়কারীকে এ চুক্তি নিরাপত্তা দেয় না।

৫৬) এ চুক্তির আওতাধীন যে কেউ, চাই সে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকুক কিংবা নিজের ঘরে অবস্থান করুক, সে নিরাপত্তাধীন হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে কোনো অন্যায় অপরাধ সংঘটন করে (ব্যক্তিগত দুর্বলতার কারণে যুদ্ধে অংশ না নিলেও তা শাস্তিযোগ্য হবে না।) এবং

৫৭) আল্লাহ তাদেরকেই রক্ষা করেন যারা সৎ এবং তাকে ভয় করে এবং মুহাম্মদ সা: তার প্রেরিত রাসুল।

মদিনা সনদের গুরুত্ব :

মদিনা সনদ ছিল মানব ইতিহাসের  একটি ঐতিহাসিক চুক্তি। বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) সারা জীবন এই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন।এ চুক্তির নানামুখী উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি ছিল যুদ্ধের পরিবর্তে পরস্পরের শান্তিপূর্ণ অবস্থান। এ চুক্তির আরও উদ্দেশ্য ছিল অত্যাচারিত-নিপীড়িতকে সাহায্য করা এবং চুক্তিভুক্ত সব পক্ষের মান-মর্যাদা ও ধর্মবিশ্বাসের অধিকার সংরক্ষণ করা। ইসলাম যে শান্তি চায়, তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো এই মদিনা সনদ।‘মদিনা সনদ’ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন সাধন করে। এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নৈরাজ্য, সংঘাত, যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করে যুদ্ধবাজ গোত্রগুলোর মধ্যে সংঘাতের পরিবর্তে গড়ে তোলে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ