গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের কারণ, লক্ষণ ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা -Health-

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের কারণ, লক্ষণ ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা

স্বাস্থ্য প্রতিবেদকঃ গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বিশেষ এক ধরনের ডায়াবেটিস, যেটি কিনা কেবল গর্ভাবস্থায় হয়ে থাকে। এসময় হরমোনের লেভেল ও নতুন শারিরীক পরিবর্তনের কারনে মায়ের শরীর সঠিক পরিমান ইনসুলিন তৈরী করতে ব্যার্থ হওয়ায় এক ধরনের হরমোন, যা অগ্ন্যাশয়ে তৈরী হয়। এটি শরীরকে রক্তের গ্লুকোজের লেভেল নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। যখনি শরীর যথেষ্ট পরিমান ইনসুলিন উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণও বেড়ে যায়। যাকে ডাক্তারী পরিভাষায় জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস মেলিটাস বলা হয়। সাধারণত ডেলিভারীর পর এইটা চলে যায়।


গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের কারণগুলি :
গর্ভাবস্থাকালীন ডায়াবেটিসের প্রধান কারণ হল দেহে ইনসুলিনের মাত্রার ওঠাপড়া।পাচন প্রক্রিয়াতে খাবারের মধ্যে থাকা কার্বোহাইড্রেটগুলি গ্লুকোজে(শর্করাতে)ভেঙে যায়, যা থেকে শক্তি উৎপন্ন হয়।এই শক্তির দ্বারাই মানুষের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পন্ন হয়ে থাকে।স্বাভাবিক অবস্থায় অগ্ন্যাশয় থেকে উৎপন্ন ইনসুলিন এই গ্লুকোজকে কোষে স্থানান্তরিত করার মাধ্যমে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধিকে প্রতিহত করে।গর্ভদশায় অমরা নামক একটি পর্দা বিকাশমান গর্ভস্থ শিশুটিকে পুষ্টি পদার্থ এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে।এই সাধারণ কাজটি করা ছাড়াও আমরা নানা ধরণের হরমোন ক্ষরণ করে যা মায়ের শরীরের স্বাভাবিক হরমোন গুলির কার্যকারিতার ওপর প্রভাব বিস্তার করে।জানা গেছে এটি ইনসুলিনের উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, তার ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায় এবং তাকে ভেঙে ফেলার মত পর্যাপ্ত ইনসুলিনের অভাবে ঘটে।এটাই হলো একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলার গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়ার মূল কারণ।

গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস এর আরেকটি কারণ হল ওজন।ইনসুলিনের ক্ষরণ কমাবার ক্ষেত্রে স্থূলতার খুব নিকট সম্বন্ধ আছে। যদি গর্ভধারণের পূর্বে মায়ের ওজন খুব বেশি হয় তাহলে তার গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই বেশি থাকে। পাশাপাশি গর্ভদশায় ওজন বৃদ্ধির ব্যাপারটিকে মাথায় রাখতে হবে সমান গুরুত্ব দিয়ে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের লক্ষণ :

অতিরিক্ত পিপাসা
গর্ভাবস্থায় তৃষ্ণা অনুভব করা একটি স্বাভাবিক ঘটনা- শরীরে রক্তের পরিমাণ বাড়াতে এবং অতিরিক্ত বর্জ্য দূরীকরণে কিডনিকে সাহায্য করতে গর্ভবতী নারীদের অতিরিক্ত তরলের প্রয়োজন হয়। আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডায়াবেটিস অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজেসের মতে, অন্য ডায়াবেটিসের মতো গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের একটি প্রধান উপসর্গ হচ্ছে, ঘনঘন তৃষ্ণা অনুভব করা। 

অতিরিক্ত প্রস্রাব
অন্য নারীদের তুলনায় গর্ভবতী নারীরা বেশি প্রস্রাব করেন, কারণ রক্তপ্রবাহ বেশি হলে প্রস্রাবও বেশি তৈরি হয়। এছাড়া মূত্রাশয়ের ওপর গর্ভস্থ বাচ্চার চাপও পড়ে।  আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডায়াবেটিস অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজেসের মতে,‘অতিরিক্ত সুগার দ্বারা কিডনি প্রভাবিত হলে তারা কঠোর পরিশ্রম করে এবং বেশি প্রস্রাব উৎপাদন করে।তাই সুগার যত বাড়বে তত বেশি প্রস্রাব তৈরি হবে। অতিরিক্ত প্রস্রাব উৎপাদিত হলে ঘনঘন প্রস্রাব করতে হবে এটাই তো স্বাভাবিক। ঘনঘন প্রস্রাব করার কারণে শরীর পানিশূন্যতার ঝুঁকিতে থাকে।’

ঝাপসা দৃষ্টি 
অন্য ডায়াবেটিসের মতো জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসেরও অন্যতম উপসর্গ হচ্ছে, চোখে ঝাপসা দেখা।ব্লাড গ্লুকোজ উচ্চ হলে চোখের ওয়াটার কনটেন্ট প্রভাবিত হয়, যার ফলে ফোকাস করতে সমস্যা হয় অথবা চোখে ঝাপসা দেখা যায়। সুগারের মাত্রা সবসময় উচ্চ থাকলে এ দৃষ্টি সমস্যা ক্রনিক হতে পারে। ইচ্ছেমতো খাবার খেয়ে হঠাৎ করে সাময়িকের জন্য ব্লাড গ্লুকোজ বেড়ে গেলেও এমনটা হতে পারে।’ ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে আনলে চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

ক্লান্তি
হরমোনগত পরিবর্তনের কারণে গর্ভাবস্থায় ক্লান্তি একটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৭৮ শতাংশ গর্ভবতী নারী ক্লান্তি অনুভব করেছিল এবং তাদের ৬০ শতাংশ ক্লান্তির কারণে দিনেও ঘুমিয়েছিল। কিন্তু অতিরিক্ত ক্লান্তি হতে পারে জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসেরও একটি উপসর্গ।সুগার বেড়ে গেলে শরীরের কোষ ও অঙ্গসমূহ প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করতে অক্সিজেন ও পুষ্টি ব্যবহার করতে পারে না। তাই এসময় শরীর ক্লান্তির মাধ্যমে এটা বলতে চেষ্টা করে যে বিশ্রাম নাও।

বমিভাব ও বমি
 আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু হরমোন বৃদ্ধির কারণে ৭৪ শতাংশ নারীর বমিভাব ও বমি হয়।
 
ওজন হ্রাস
বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভধারণের আগে ওজনকে স্বাস্থ্যকর লেভেলে নিয়ে আসার চেষ্টা করা উচিত, কিন্তু গর্ভবতী হয়ে গেলে ওজন কমানো উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের গাইডলাইনে বলা হয়েছে, গর্ভাবস্থার যেকোনো পর্যায়ে ওজন কমে যাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে এবং এসময় ওজন হ্রাস পেলে চিকিৎসককে জানাতে হবে।ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে কোষসমূহ সুগারকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না। শরীর শক্তির এ ঘাটতিকে উপবাস মনে করে ক্ষুধাকে উদ্দীপ্ত করে। এটি একটা দুষ্টুচক্র সৃষ্টি করে, অর্থাৎ আপনি ক্ষুধা অনুভব করে খাবার খাবেন, কিন্তু আপনার শরীর খাবারগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে না, যার ফলে ওজন কমে যাবে।’ ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে, যেসব স্থূল নারীর জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসের কারণে ওজন কমে গিয়েছিল তারা স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের বাচ্চা প্রসব করেছিল। এছাড়া এসব নারীরা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ওজনের বাচ্চা প্রসব অথবা নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বাচ্চা জন্মদান অথবা খর্বাকৃতির বাচ্চা প্রসবের ঝুঁকিতেও থাকেন। তাই গর্ভবতী নারীদের ওজন হ্রাস পেলে চিকিৎসককে জানানো উচিত।

নাক ডাকা
গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক ফোলা থেকে নাসিকাপথ সংকুচিত হয়ে নাক ডাকতে পারে। কিন্তু আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডায়াবেটিস অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজেসেরএকটি গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, নাক ডাকার সঙ্গে জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসের যোগসূত্র থাকতে পারে। প্রেগন্যান্সিতে নাক ডাকা স্বাভাবিক হলেও এটা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসেরও উপসর্গ হতে পারে। 

ঘনঘন ইনফেকশন
গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিস রোগীদের ঘনঘন ইনফেকশনের প্রবণতা বেশি। এমনিতে গর্ভাবস্থায় নারীদের যোনি ও মূত্রতন্ত্রে ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি বেশি, কিন্তু জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বিকশিত হলে ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য শুধুমাত্র ইনসুলিন ইনজেকশন ব্যাবহার করতে হবে। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার ঔষধ ব্যবহার না করাই ভাল। যাদের গর্ভসঞ্চারের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে এবং মুখে খাওয়ার ঔষধ ব্যবহার করেন। তাদের ক্ষেত্রে, গর্ভসঞ্চার হয়েছে বোঝার সাথে সাথেই মুখে খাওয়ার ঔষধ বন্ধ করে ইনসুলিন ব্যাবহার শুরু করতে হবে।অনেক মহিলার ক্ষেত্রে কোনও ঔষধের প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং মাঝারি ধরণের শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরকে সুস্থ রাখা সম্ভব। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল বিষয়গুলো হলো সঠিকভাবে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, পরিমিত হাল্কা ব্যায়াম, নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ডায়াবেটিসের মাত্রা নিরূপণ, নিয়মিত গাইনি অথবা ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ।গর্ভাবস্থায় সকলেরই সঠিক পরিমাণে ও সুষম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে রোগীকে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট খাদ্য তালিকা মেনে চলতে হবে। সাধারণভাবে খাদ্যতালিকায় দৈনিক শতকরা ৪০ ভাগ আমিষ, ৪০ভাগ শর্করা ও ২০ ভাগ চর্বি জাতীয় খাদ্য বা ফ্যাট থাকতে পারে। গর্ভকালীন সময়ে অবশ্যই একজন পুষ্টিবিদ অথবা একজন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শমত খাদ্য তালিকা মেনে চলতে হবে। ডায়াবেটিসের রোগীদের গর্ভাবস্থায় নিয়মিতভাবে হাল্কা হাঁটার অভ্যাস থাকা ভালো, তবে কোনো অবস্থাতেই কোনো ভারি ব্যায়াম করা ঠিক না।নিয়মিতভাবে রক্তের সুগার পরীক্ষা ও ইনসুলিনের মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়াও নিয়মিত রক্তচাপ মাপা, গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা সেটা পরিমাপ করাও একজন গর্ভকালীন ডায়াবেটিক মহিলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো জটিলতা না থাকলে একজন গর্ভকালীন ডায়াবেটিক মহিলার প্রসব স্বাভাবিকভাবে হতে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলেই সিজারিয়ান অপারেশন করতে হবে এমন কোন কথা নেই। প্রসবের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খেতে দিতে হবে।

আরও পড়ুন:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ