স্বাস্থ্য প্রতিবেদক : বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে দিনে ছয় থেকে আটবার প্রস্রাব করা স্বাভাবিক কিন্তু দিনের বেলা আটবারের বেশি ও রাতে ঘুমানোর সময় একবারের বেশি প্রস্রাবের বেগ আসলে তা অস্বাভাবিক হিসেবে ধরা যেতে পারে।মূত্রনালীর সংক্রমণ বা ইউটিআই (UTI) এর কারণে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়।
ঘন ঘন প্রস্রাবের কারণসমূহ
১) ডায়াবেটিসের একটি প্রাথমিক উপসর্গ হলো ঘনঘন প্রস্রাব করা, কারণ শরীর প্রস্রাবের মাধ্যমে অব্যবহৃত শর্করা বের করে দিতে প্রচেষ্টা চালায়। ডায়াবেটিস রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে কিডনির শর্করা ব্যবস্থাপনার কাজ বেড়ে যায়। কিন্তু কিডনি একাজে ব্যর্থ হলে বাড়তি শর্করাকে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। ঘনঘন প্রস্রাব করার কারণে শরীর তরল হারায়। তাই শরীর টিস্যুর তরল ব্যবহার করে ডায়াবেটিস রোগীকে পানিশূন্যতায় ভোগায়। শরীর পানিশূন্যতায় ভুগে বলে ঘনঘন পিপাসা লাগে। একারণে ডায়াবেটিস রোগীরা শুরুর দিকে সচরাচরের চেয়ে বেশি পান করেন। একারণেও প্রস্রাব করার হার বেড়ে যায়।
২) বেশি বেশি পানি পান করা একটি প্রধান কারণ। দৈনিক নিয়মিত দেড়-দুই লিটার পানি শরীরে ঢোকা (by drinking) ও শরীর থেকে বের হওয়া (by kidneys) হচ্ছে স্বাভাবিক। এর বেশি হলেই অতিরিক্ত।
৩) শীতকাল বা ঠান্ডা-শুষ্ক পরিবেশে মানুষের শরীর ঘামে না, ঐ সময় অতিরিক্ত প্রস্রাব তৈরি করে কিডনী শরীরে পানি ও লবণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
৪)ঘনঘন প্রস্রাবের আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হলো স্ট্রোক। স্ট্রোকের বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে ঘনঘন প্রস্রাব আসতে পারে।
৫) কিছু রোগের লক্ষণ হিসেবে অতিরিক্ত প্রস্রাব হয়, যেমন- ডায়াবেটিস, প্রস্টেট গ্রন্থির টিউমার, প্রস্রাবে জীবাণু সংক্রমণ ইত্যাদি।
৬) কিডনী অকেজো হবার অন্যতম লক্ষণ হল অতিরিক্ত প্রস্রাব হওয়া।
৭) গর্ভবতী মায়েদের ইউটেরাস যত বাড়তে থাকে ততই প্রস্রাবের থলি ব্লাডারে তত চাপ পরে৷ ফলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়৷
৮) এছাড়া এলকোহল/চা/কফি পান করা এবং কিছু ওষুধ যেমন- ফ্রুসেমাইড/থায়াজাইড ইত্যাদি সেবন করাও কিন্তু অতিরিক্ত প্রস্রাব হবার জন্য দায়ী।
৯) ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ বিরলক্ষেত্রে মূত্রাশয় ক্যানসারের উপসর্গ হতে পারে। ক্যানসারটি মূত্রাশয়কে উক্ত্যক্ত করে প্রস্রাবের তাড়না বাড়াতে পারে। মূত্রাশয়ে ক্যানসার হয়েছে কি হয়নি তা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হলো ইউরোলজিস্টের কাছে যাওয়া। কিন্তু বারবার প্রস্রাব হলে ক্যানসার হয়েছে সন্দেহে আতঙ্কিত হবেন না, কারণ মূত্রাশয়ে ক্যানসার হওয়ার ঘটনা খুবই কম দেখা গেছে। ঘনঘন প্রস্রাবের বেগ আসলে মূত্রাশয় ক্যানসারের অন্যকোনো উপসর্গ আছে কিনা দেখুন। এই ক্যানসারের আরেকটি লক্ষণীয় উপসর্গ হলো প্রস্রাবে রক্তের উপস্থিতি।
ঘন ঘন প্রস্রাবের লক্ষণ
১. ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসা, কিন্তু কোনবারই যথেষ্ট পরিমাণ প্রস্রাব হবে না।
২. প্রস্রাব করার সময় তীব্র ব্যথা এবং জ্বালাপোড়া অনুভব হবে।
৩. শরীর দুর্বল হওয়া, পিঠের নিচের দিকে বা তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হওয়া।
৪. ঘোলা ও দূর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব হওয়া বা কখনো কখনো প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া।
৫. প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া ভাবের সাথে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে।
৬. প্রস্রাব আটকে রাখতে না পারা।
৭. ছোটদের ক্ষেত্রে ডায়ারিয়া, জ্বর, খেতে না চাওয়া ইত্যাদি নানা উপসর্গ দেখা যায়।
নিম্ন লিখিত এসব উপসর্গ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আরও পড়ুনঃ
থাইরয়েডের কারণ, লক্ষণ ও থাইরয়েড রোগের চিকিৎসা
ঘন ঘন প্রস্রাব হলে যা খাবেন না
বা যেসব খাবার খেলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়
১. মূত্রনালির সংক্রমণ, মূত্রস্থলী (ব্লাডার) সমস্যা বা ওএবি থাকলে সোডা বা সোডাযুক্ত খাবার অথবা সোডাপানীয় খেলে সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। তাই কার্বনেটেড বা সাইট্রাস সোডা বা সোডাযুক্ত খাবার অথবা এসব পানীয় থেকে দূরে থাকুন।
২. যদি আপনার মূত্রস্থলীতে সংক্রমণ হয়ে থাকে তাহলে কফি খাওয়ার অভ্যাস ছাড়ুন। কফির মধ্যে থাকা ক্যাফেইন মূত্রস্থলীর অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দেয়।
৩. ফল খাওয়া শরীর-স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। তবে যদি আপনার মূত্রস্থলীতে কোন সমস্যা থাকে তাহলে অ্যাসিডিক ফল (যেমন আঙুর, কমলালেবু, আপেল, টমেটো, আনারস ইত্যাদি) মূত্রনালির সংক্রমণ বাড়িয়ে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে এসব ফল না খাওয়া বা যতটা সম্ভব কম খাওয়াই ভাল।
৪. ক্যালরির পরিমাণ কমানোর জন্য অনেকেই খাবারে চিনির বদলে কৃত্রিম সুইটেনার ব্যবহার করে থাকেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি মূত্রনালিতে সংক্রমণ বা কোন রকম সমস্যা থাকে তাহলে কৃত্রিম সুইটেনার থেকে দূরে থাকাই ভাল। কারণ এতে সমস্যা আরও বাড়তে পারে।
৫. মূত্রনালি বা মূত্রস্থলীতে সংক্রমণ বা কোন রকম সমস্যা থাকলে অতিরিক্ত মশলাদার খাবার-দাবার এড়িয়ে চলুন। কারণ ঝাল বা অতিরিক্ত মশলাদার খাবার-দাবার মূত্রস্থলীতে অস্বস্তি তৈরি করে।
৬. মদ পান করলে যে বেশি প্রস্রাব পায়, এ কথা অনেকেই জানেন। অ্যালকোহলের প্রভাবে পেটের সঙ্গে সঙ্গে মূত্রস্থলীতেও অস্বস্তি তৈরি হয়। তাই সংক্রমণের প্রবণতা থাকলে বা মূত্রস্থলীতে কোন রকম সমস্যা থাকলে অ্যালকোহল থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকুন।
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ার কারণ
-শরীরে জলের অভাব।
-মূত্রনালী ট্রাকে ইনফেকশন।
-গর্ভাবস্থায় প্রস্রাবে ব্যথা এবং জ্বলন সংবেদন।
-জাঙ্ক ফুড বা ফাস্ট ফুডের অতিরিক্ত সেবন।
-লিভারের সমস্যার কারণে প্রস্রাবের সমস্যা হতে পারে।
-পাথর বা কিডনিতে পাথরের সমস্যা হওয়া ।
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ার লক্ষণ
-পেট ব্যথা।
-জ্বর।
-অনিয়ন্ত্রিত ঠান্ডা লাগা।
-ডায়রিয়া হওয়া।
- অনেক মলত্যাগ হওয়া এবং বমি করা।
-দিন বা রাতে প্রস্রাব অতিরিক্ত হওয়া।
-প্রস্রাবে রক্ত।
-ফেমারের অভ্যন্তরের অংশে ব্যথা।
-পিঠে ব্যাথা।
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া প্রতিরোধে যা করবেন
-নিয়মিত ইউরিনেট করুন এবং আপনার মূত্রাশয় পুরোপুরি খোলা রাখুন।
-প্রচুর তরল পান করুন।
-বেশি সময় অবধি প্রস্রাব বন্ধ করবেন না।
-সর্বদা যোনি পরিষ্কার করুন।
-বেশি লোকের সাথে অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক এড়িয়ে চলুন।
-নিরাপদ যৌনতার জন্য সর্বদা কনডম ব্যবহার করুন।
-ঘুমানোর সময় যৌনতা পর প্রস্রাব করুন।
-সুতি বা আলগা অন্তর্বাস, নন-বাইন্ডিং পোশাক পরিধান করুন যা তাপ এবং আর্দ্রতা শোষণ করে না।
আরও পড়ুনঃ
0 মন্তব্যসমূহ