ইসলামিক ডেস্কঃ ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো হজে বায়তুল্লাহ। ঈমান, নামাজ, জাকাত ও রোজার পরই হজের অবস্থান। হজ শুধু সামর্থ্যবান মুসলিমের ওপর ফরজ করা হয়েছে।
ইসলামিক পরিভাষায় জিলহজ্বের ৯ তারিখ ইহরাম বেঁধে আরাফাতের মাঠে অবস্থানসহ কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে নির্ধারিত কয়েকটি আমল যথাযথভাবে আদায় করে কাবা গৃহ তাওয়াফ করাকে হজ বলা হয়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের ওপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্ব করা ফরজ। আর কেউ যদি অস্বীকার করে তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’ সূরা আলে ইমরান : ৯৭।
হজ্ব পালনের নিয়ম
হজের নিয়ত
আল্লাহুম্মা ইন্নী উরীদুল হাজ্জা ফায়াচ্ছিরহু-লী অ-তাকাব্বালহু মিন্নী। বাংলা নিয়ত- হে আল্লাহ আমি পবিত্র হজ পালনের জন্য ইহরাম বেঁধে নিয়ত করলাম তা সহজ করে দিন এবং কবুল করে নিন।
হজের প্রকারভেদ
হজের তিন প্রকার
১) হজে ইফরাদ
বর্ণনা: ওমরাহ ব্যতিত শুধু হজের জন্য ইহরাম বাঁধা এবং হজের সঙ্গে ওমরাহকে না মিলানো। (বদলি হজের জন্যও এই হজ)।
নিয়ত: আল্লাহুমা ইন্নী উরীদুল হাজ্জা ফায়াসছির হুলিওয়াতা কাব্বালহুমিনি্ন। (বাংলা নিয়ত- আল্লাহ আমি ইফরাদ হজের উদ্দেশে আপনার সন্তুষ্টির জন্য ইহরাম বাঁধলাম। তা সহজ করে দিন ও কবুল করে নিন)।
২) হজে কিবরান
বর্ণনা: একত্রে একই স্থান থেকে হজ ও ওমরার নিয়ত করে হজের সঙ্গে ওমরাহকে মিলানো এবং একই ইহরামে উভয়টি আদায় করা।
নিয়ত: আল্লাহুমা ইন্নী উরীদুল উ’মরাতা ফায়াচ্ছির লি-ওয়াতাকাব্বাল মিন্নী। (হে আল্লাহ আমি আপনার উদ্দেশে হজে কিবরানের জন্য ইহরাম বাঁধলাম তা সহজ করে দিন ও কবুল করে নিন। )
৩) হজে তামাত্তু
বর্ণনা: একই সফরে পৃথক ভাবে ‘ইহরাম’ পরিধান করে ‘হজ ও ওমরাহ’ আদায় করা। প্রথম ইহরামে ওমরাহর নিয়ত করে তা পালন শেষে চুল কেটে ‘ইহরাম’ খুলে হালাল হয়ে দ্বিতীয়বার নতুন করে হজের নিয়তে ৮ই জিলহজ ‘মক্ক শরীফ’ থেকে হজের জন্য ইহরাম বাঁধা। তামাত্তু করার ইচ্ছা থাকলে প্রথমে ওমরার নিয়্যাত করে এহরাম বাঁধুন।
হজের ফরজ ৩টি
১। ইহরাম বাঁধা।
২।উ’কুফে আ’রাফা (আরাফাতের ময়দানে অবস্থান)।
৩।তাওয়াফুয যিয়ারাত।
হজের ওয়াজিব ৬টি
১. ‘সাফা ও মারওয়া’ পাহাড়গুলো মধ্যে ৭ বার সায়ি করা।
২. অকুফে মুযদালিফায় (৯ই জিলহজ) অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যদয় পর্যন্ত একমুহূর্তের জন্য হলেও অবস্থান করা।
৩. মিনায় তিন শয়তান (জামারাত) সমূহকে পাথর নিক্ষেপ করা।
৪. ‘হজে তামাত্তু’ ও ‘কিবরান’ কারীরা ‘হজ’ সমাপনের জন্য দমে শোকর করা।
৫. এহরাম খোলার পূর্বে মাথার চুল কাটা।
৬. মক্কার বাইরের লোকদের জন্য তাওয়াফে বিদা অর্থাৎ মক্কা থেকে বিদায়কালে তাওয়াফ করা।
তাওয়াফের বিবরণ
হাজীদের সর্বপ্রথম কাজই হলো (তামাত্তু ও ক্বেরান কারীরা) নিজের মালছামান গুছিয়ে রেখে পাক পবিত্র হয়ে মোটেই দেরি না করে ‘হারাম শরীফে’ হাজিরা দেওয়া এবং ‘তাওয়াফ’ করা। ওমরাহ এবং হজের তাওয়াফ ব্যাতিত নফল তাওয়াফ ও করা যায়। যেমন- রাসূল (সা.), সাহাবা-আওলিয়া, আহ্লে বাইত, মা-বাবা, পীর-উস্তাদ ও অন্যান্য মুরুব্বি বা সন্তানদের স্মরণে বা তাদের নামে তাওয়াফ করা।
তাওয়াফের নিয়ত
আল্লাহুম্মা ইন্নী উরীদু তাওয়াফা বাইতিকাল হারাম ফায়াচ্ছিরহু-লী, ওয়া তাক্বাব্বাল-হু-মিন্নী, সাবাআ’তা আশ্ওয়াতি্বন লিল্লাহি তায়া’লা। বাংলায় নিয়ত- হে আল্লাহ আমি তাওয়াফ পালনের জন্য নিয়ত করলাম।
তাওয়াফের ওয়াজিবসমূহ
১. শরীর পাক-সাফ রাখা, অজু করা। নারীদের হায়েজ নেফাছ অবস্থায় তাওয়াফ করা জায়েজ নাই।
২. ছতর ঢাকা। অর্থাৎ যেটুকু ঢাকা প্রত্যেক পুরুষ-নারীর জন্য ফরজ।
৩. ‘হাতীমে কা’বার’ বাইরে থেকে ‘তাওয়াফ’ করা।
৪. পায়ে হেঁটে ‘তাওয়াফ’ করা। অম ব্যক্তি খাটিয়ার মাধ্যমে ‘তাওয়াফ’ করতে পারেন।
৫. ‘হাজের আসওয়াদ’ থেকে শুরু করে ডানদিক দিয়ে ‘তাওয়াফ’ শুরু করা।
৬. এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে ‘সাতবার চক্কর’ দিয়ে ‘তাওয়াফ’ পূর্ণ করা।
৭. ‘সাত চক্করে’ এক ‘তাওয়াফ’, এটা পূর্ণ হলেই ‘তাওয়াফের’ নামাজ পড়া।
আরও পড়ুনঃ
তাওয়াফের সুন্নত কার্যাবলী
১. ‘তাওয়াফে’র শুরুতে ‘হাজারে আসওয়াদ’ এর দিকে মুখ করা।
২. সম্ভব হলে ‘হাজের আসওয়াদ’ চুম্বন করা। নতুবা হাত দ্বারা দূর থেকে ইশারা করা, এবং মুখে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ’ বলা।
৩. ‘হাজের অসওয়াদ’ বরাবর দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরিমা’র ন্যায় উভয় হাত সিনা পর্যন্ত উঠান।
৪. যে ‘তাওয়াফে’র পরে ‘সাঈ’ আছে তাতে ‘এযতেবা’ করা। অর্থাৎ ইহরামের চাদরের (উপরের অংশের) দুই মাথা ডান বগলের নিচ দিয়ে বাম কাঁধের উপর ফেলে দেওয়া।
৫. ‘সাঈ’ যুক্ত ‘তাওয়াফে’র প্রথম তিন চক্করে ‘রমল’ করা। অথাৎ বীরের মতো হেলে দুলে জোর কদমে (একের পর এক পা ফেলে) চলা।
৬. বাকি চার চক্কর সাধারণ গতিতে (ধীরে ধীরে) সম্পন্ন করা।
৭. প্রত্যেক চক্কর তাওয়াফ শেষ করে এবং শেষ চক্করেরও পরে ‘হাজের অসওয়াদ’কে চুম্বন করা। সম্ভব না হলে দূর থেকে ইশারা করে বিসমিল্লাহে আল্লাহ আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ’দোয়াটি পাঠ করা এবং ৩ নম্বর নিয়মের ন্যায় দাঁড়িয়ে ইশারা করে ‘তাওয়াফ’ শেষ করা।
ইহরাম বাঁধার পর নিষিদ্ধ কাজ সমুহ
১) সেলাইযুক্ত যে কোন কাপড় বা জুতা ব্যবহার, এক্ষেত্রে স্পঞ্জ সেন্ডেলের ব্যবহার করতে হবে।
(২) মস্তক ও মুখমন্ডল (ইহরামের কাপড়সহ যে কোন কাপড় দ্বারা) ঢাকা।
(৩) পায়ের পিঠ ঢেকে যায় এমন জুতা পরা।
(৪) চুলকাটা বা ছিড়ে ফেলা।
(৫) নখকাটা।
(৬) ঘ্রানযুক্ত তৈল বা আতর লাগানো।
(৭) স্ত্রীর সঙ্গে সংগম করা।
(৮) যৌন উত্তেজনামূলক কোন আচরণ বা কোন কথা বলা।
(৯) শিকার করা।
(১০) ঝগড়া বিবাদ বা যুদ্ধ করা।
(১১) চুল দাড়িতে চিরুনী বা আঙ্গুলী চালনা করা, যাতে ছিড়ার আশংকা থাকে।
(১২) শরীরে সাবান লাগানো।
(১৩) উকুন, ছারপোকা, মশা ও মাছিসহ কোন জীবজন্তু হত্যা করা বা মারা।
(১৪) যে কোন ধরণের গুনাহের কাজ করা।
হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ সম্পর্কে রাসুল(সা.) বলেন , ‘মাকবুল হজের একমাত্র প্রতিদান হলো বেহেশত।’( সহিহ্ বোখারি : ১৭৭৩)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজপালন করবে এবং হজ সমাপনকালে স্ত্রী সহবাস কিংবা তৎসম্পর্কিত আলোচনা এবং কোনো প্রকার গোনাহের কাজে লিপ্ত হবে না, সে সদ্যজাত শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে (বাড়ি) ফিরবে।’ (সহিহ্ বোখারি : ১৫২১,)।
হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে বলা হয় , আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! নারীদের জন্য কি জেহাদ আছে? তিনি উত্তরে বললেন, তাদের জন্য জেহাদ আছে, তবে তাতে যুদ্ধ নেই, আর তা হলো ‘হজ ও ওমরাহ।’ (ইবনে মাজাহ : ২৯০১)।
হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য এক হাদিসে আছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আরাফার দিন অপেক্ষা আর কোনোদিন আল্লাহতায়ালা তার এত বেশি বান্দাকে দোজখ থেকে মুক্তি দেন না।’ (সহিহ্ মুসলিম : ৩৩৫৪)।
হজ একটি ফরজ ইবাদত, যা পালন করা সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর দায়িত্ব। কিন্তু আল্লাহর অপার অনুগ্রহ হলো, হজ পালনের কারণে শুধু মানুষকে দায়মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে তা নয়; মানুষের সব পাপও ক্ষমা করে দেওয়া হচ্ছে এবং চিরস্থায়ী আনন্দ ও সুখ দ্বারা পুরস্কৃত করা হচ্ছে। সর্বোপরি নবী কারিম (সা.) হজকারীর জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।
আরও পড়ুনঃ
0 মন্তব্যসমূহ