মুসলীম বিয়েতে প্রচলিত কিছু কুপ্রথা

মুসলীম বিয়েতে প্রচলিত কিছু কুপ্রথা
ইসলামি ডেস্কঃ বিয়ে নিয়ে আমাদের সমাজে বিভিন্ন প্রকার প্রথা ও রীতি প্রচলিত আছে যা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম এবং বিদ’আত। বিয়ের সময় গায়ে হলুদ, যৌতুক বা গান বাজনা করা ইত্যাদি হারাম তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এছাড়া বিয়েতে আরো কিছু কুপ্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে।

বিয়েতে প্রচলিত কিছু কুপ্রথা 
অথবা বিয়েতে সুন্নাহ বিরোধী কাজ সমূহ
অথবা বিয়েতে ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম  

মেয়ে দেখা
মেয়ে দেখার ক্ষেত্রে পাত্র পক্ষের মহিলারা ও পাত্র নিজে দেখতে পারেন। অন্য কোন পুরুষ লোক মেয়ে পক্ষের সাথে আলোচনা করতে পারবেন কিন্তু মেয়ে দেখতে পারবেন না। এমনকি বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার আগে পাত্রের বাবা কিংবা ভাইও পাত্রীকে দেখতে পারবে না। তবে পাত্রের নিজে দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের নিজ চোখে পাত্রী দেখে পছন্দ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

বিয়ের মোহরানা
বিয়ের মোহরানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সামাজিক সম্মান বিবেচনা করে অসম্ভব বা অসাধ্য পরিমাণ মোহরানায় রাজি হওয়া বা বরপক্ষকে চাপ দিয়ে রাজি করানো শরীয়ত সম্মত কাজ নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নগদ মোহরানা দিয়ে বিয়ে করেছেন এবং সাহাবীদের সাধ্য মতো মোহরানা দিয়ে বিয়ে পড়িয়েছেন। মোহরানা হতে পারে টাকা পয়সা, জমি-জমা, অলংকার। এমনকি জ্ঞান বা শিক্ষাও মোহরানা হতে পারে।

মেয়ের কবুল বলা
আমাদের সমাজে আরেকটি বিদ’আত হচ্ছে বিয়ের দিন মেয়ের তিনবার কবুল বলা। বস্তুত মেয়ের কবুল বলার কোন প্রয়োজন বা বিধান নেই। বিয়ের দিন মেয়ের অভিভাবক মেয়ের বিয়েতে সম্মতি দিলে ছেলে কবুল বললেই বিয়ে হয়ে যায়। তাই বিয়ের দিন মেয়ের কোন কাজ নেই। অভিভাবককে আগেই মেয়ের অনুমতি নিয়ে নিতে হয়। উল্লেখ্য মেয়ের অনুমতি ছাড়া বিয়ে হবে না।

আবু সালামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের কাছে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ কোন সাইয়্যেবা (তালাক প্রাপ্তা বা বিধবা) নারীকে তার সম্মতি ব্যতীত বিয়ে দেয়া যাবে না এবং কুমারী মহিলাকে তার অনুমতি ছাড়া বিয়ে দিতে পারবে না। লোকেরা জিজ্ঞেস করলঃ হে আল্লাহর রাসূল, কেমন করে তার অনুমতি নেয়া হবে? তিনি বললেনঃ তার চুপ থাকাটাই হচ্ছে তার অনুমতি। [সহীহ বুখারী, অধ্যায় ৬৭, হাদিস নম্বর ৫১৩৬]।

আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, নিশ্চয়ই কুমারী মেয়েরা লজ্জা করে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ তার চুপ থাকাটাই হচ্ছে তার সম্মতি। [সহীহ বুখারী, অধ্যায় ৬৭, হাদিস নম্বর ৫১৩৭]।

উকিল বানানো
বিয়ের দিন উকিল ও সাক্ষী দিয়ে মেয়ের অনুমতি নেয়ার প্রথা আমাদের দেশের অনেক জায়গায় প্রচলিত। মেয়ের অনুমতি নেয়ার দায়িত্ব তার অভিভাবকের। তাই অভিভাবক থাকাকালীন বাইরের কোন লোককে উকিল বানানো এবং উকিল বা সাক্ষীর মাধ্যমে মেয়ের অনুমতি গ্রহণ করা ইসলাম সম্মত নয়।

কবুল করার পর সালাম করা
আমাদের দেশে আরেকটি বিদ’আত হল কবুল বলার পর বর দাড়িয়ে সবাইকে সালাম করে। প্রকৃতপক্ষে সালাম করতে হয় কারো সাথে দেখা হলে বা বিদায় নেওয়ার সময়। কবুল বলার পর বিয়ের অনুষ্ঠানের মাঝখানে দাড়িয়ে এভাবে সালাম দেওয়ার প্রথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে ছিল না।

মেয়ে পক্ষের খরচ করা
 ইসলাম সম্মত বিয়েতে বিয়ের সময় বা বিয়ের অনুষ্ঠানে মেয়ে পক্ষের খরচ করার মত তেমন কিছু নেই। বিয়েতে মোহরানা দিবে ছেলে। ওয়ালিমা করবে ছেলে। কনে ঘরে আনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ঘরের আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করবে ছেলে। অথচ আমাদের দেশের নিয়ম ঠিক তার উল্টো। যৌতুক দেয় মেয়ে পক্ষ, অনুষ্ঠান করে লোক খাওয়ায় মেয়ে পক্ষ, মেয়ের সাথে প্রয়োজনীয় ফার্নিচার বা আসবাবপত্র দেয় মেয়ে পক্ষ। এ সবই হচ্ছে বিদ’আতি প্রথা।

বিয়ের দিন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা
আমাদের দেশের প্রচলিত বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ে পক্ষ ঘটা করে অনুষ্ঠান করে লোক দাওয়াত দিয়ে খাওয়ায়। ইসলামী দৃষ্টিতে মেয়ে পক্ষের অনুষ্ঠান করা বা লোক খাওয়ানোর কোন বিধান নেই। তবে বরপক্ষের লোকদের জন্য মেহমানদারী করা যায়। বরপক্ষকেও যথাসম্ভব কম সংখ্যক মানুষ নিয়ে মেয়ের বাড়িতে যাওয়া উচিত যেন মেয়ে পক্ষের উপর অতিরিক্ত কোন চাপ সৃষ্টি না হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সামাজিক নিয়মের চাপে পড়ে মেয়ের বাবা মা ধার-দেনা করে বিয়ের আয়োজন করে আর বরপক্ষ বরযাত্রী নিয়ে ধুমধাম করে এসে দাওয়াত খায়। উপরন্তু খাবারের আয়োজনে সমস্যা হলে মেয়ে পক্ষকে দুই একটি কথা না শুনিয়ে ছাড়ে না। বস্তুত এ সবই ইসলামের নিয়মের বাইরে আমাদের সামাজিক প্রথা যা অন্যায় এবং ইসলামী সংস্কৃতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

মালামাল দেওয়া
বিয়েতে কনে পক্ষ বিয়ের দিন বরের বাড়িতে যে মালামাল আসবাবপত্র পাঠায় তাও ইসলামী সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এগুলো বিদ’আত এবং তাতে মেয়ে পক্ষের উপর খরচের চাপ পড়ে এবং খরচ মিটাতে গিয়ে মেয়ের বাবা মা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

উপহার নেওয়া
আমাদের দেশি বিয়েতে উপহার নেওয়ার প্রথা রয়েছে। শুধু তাই নয়, বিয়েতে উপহার নিয়ে তা লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। গেইট দিয়ে ঢুকেই উপহার গ্রহণকারী লোক জনের মুখোমুখি হতে হয়। এতে যারা উপহার নিয়ে আসেন নিবা উপহার আনার সামর্থ্য যাদের নেই তারা ভীষণ বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েন। উপহার লিপিবদ্ধ করার কারণে দামী উপহার না দিলে সামাজিক অবস্থান হারানোর একটা আশংকা থাকায় অনেকে বাধ্য হয়ে দামী উপহার দিতে বাধ্য হন। অনেকে উপহার সামগ্রী দেওয়ার অসামর্থ্যের কারণে বিয়েতে আসেন না। উপহার সামগ্রী দেওয়া একটা সওয়াবের কাজ কিন্তু এভাবে পরোক্ষ চাপ দিয়ে উপহার সামগ্রী আদায় করা সম্পূর্ণ অনৈসলামিক।

ওয়ালিমা না করা
আমাদের দেশের প্রচলিত বিয়েতে মেয়ে পক্ষ ঘটা করে অনুষ্ঠান করলেও ছেলে পক্ষ অনেক ক্ষেত্রে ওয়ালিমা করে না। এটা শরীয়তের দৃষ্টিতে পুরো উল্টো সিস্টেম। ইসলামে মেয়ে পক্ষের অনুষ্ঠান করা বা লোক খাওয়ানোর কোণ বিধান নেই। কিন্তু ছেলে পক্ষের ওয়ালিমা করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। কিছু কিছু আলেম ওয়াজিবও বলেছেন। নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবী আব্দুর রহমান বিন আওয়াফ রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিয়ের পর তাকে বললেন যে, কমপক্ষে একটা ছাগল দিয়ে হলেও ওয়ালিমা করো। ওয়ালিমার দাওয়াতের ক্ষেত্রে গরীবদের অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। সবচেয়ে নিকৃষ্ট খাবার হচ্ছে সে ওয়ালিমার খাবার যেখানে ধনীদেরকে তো ডাকা হয় কিন্তু গরীবদেরকে ডাকা হয় না।


চাচাতো বোনের মেয়ে বিয়ে করা
আমাদের দেশের অনেকের ধারণা চাচাতো বোন, মামাতো বোন, খালাতো বোনদের মেয়ে বিয়ে করা জায়েজ নয় কারণ তারা আমাদের ভাগ্নি বা ভাতিজী হয়। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের বিয়ে করা জায়েজ।

পালিয়ে বিয়ে করা
মেয়ের অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া পালিয়ে বিয়ে করা ইসলামে হারাম। অর্থাৎ মেয়ের শরীয়ত সম্মত অভিভাবক ছাড়া বিয়ে শরীয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদীসের মধ্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যে কোন নারী তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিয়ে করবে তার বিয়ে বাতিল, তার বিয়ে বাতিল, তার বিয়ে বাতিল”। আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “ওলী বা অভিভাবক ছাড়া কোন বিয়ে হয় না”। [আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, আহমাদ]

ওলী অর্থ হচ্ছে শরীয়ত সম্মত অভিভাবক। অপরপক্ষে একটি ছেলে তার অভিভাবকের সম্মতি ছাড়াও বিয়ে করতে পারে। তাই আজকের যুব সমাজে প্রচলিত কোর্ট ম্যারেজের ক্ষেত্রে অন্তত মেয়ে পক্ষের অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে। তাছাড়া সে বিয়ে ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে যদি কোন মেয়ে মনে করে যে, তার অভিভাবক কোন কিছুর লোভে বা কারো ভয়ে তাকে কুপাত্রের কাছে বিয়ে দিতে চাচ্ছে বা তাদেরকে বোঝানো যাচ্ছে না আবার বিয়েতে রাজি না হলে কোন প্রকার সমস্যা হবে অথবা ইয়ারো অনেক সমস্যার কারণে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় না থাকে তবে সেক্ষেত্রে কোন বিজ্ঞ আলেমের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে বিয়ে করা উচিত।

আরও পড়ুনঃ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ